‘মেয়র মেডিক্যালে যাও, বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি’

চার দিন পরেই ভোট। তার আগে যেন শাসকের মাথাতেই ভেঙে পড়ল উড়ালপুল। রবীন্দ্র সরণির ধারে অশ্বত্থ-আগাছায় ঢেকে যাওয়া তেতলা বাড়ি। ইট-হাড়-পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৪
Share:

ঘটনাস্থলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ কমিশনার। ছবি: সুমন বল্লভ।

চার দিন পরেই ভোট। তার আগে যেন শাসকের মাথাতেই ভেঙে পড়ল উড়ালপুল।

Advertisement

রবীন্দ্র সরণির ধারে অশ্বত্থ-আগাছায় ঢেকে যাওয়া তেতলা বাড়ি। ইট-হাড়-পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। এরই সামনে বসে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুটপাথে চেয়ার পেতে। মিনিডোর গাড়ির দু’মাথায় দুটি মাইক তত ক্ষণে লাগিয়ে ফেলা হয়েছে। লম্বা কালো তার টেনে মাউথ স্পিকারটাও এ বার চলে এলো তাঁর হাতে। বিকেল সওয়া তিনটে। বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ায় বিপর্যয় মোকাবিলার ‘টোটাল কন্ট্রোল’ মুহূর্তে চলে এলো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।

তার পর দিদি যা যা করতে পারেন সবই হল— ‘‘দেখুন এটা বড় বিপর্যয়। চার পাঁচটা ক্রেন আনতে বলেছি। সেনাকেও বলেছি। অ্যাই সিইএসসি কী চাইছে আমাকে বলুন। কর্পোরেশনের লোকেরা তোমরা ডান দিকে যাও, ফায়ার ব্রিগেডকে ওখানে দেখতে পাবে।’’

Advertisement

দাঁতন, কেশিয়াড়ি ও খড়্গপুরে আজ নির্বাচনী সভা করার কথা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিপর্যয়ের খবর পাওয়া মাত্র সে সব বাতিল করে দেন দিদি। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে এসে নামেন ডুমুরজলায়। তার পর সোজা রবীন্দ্র সরণি। ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসই আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। বেলা আড়াইটে পর্যন্ত আর কারও দেখা মেলেনি। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও না। কিন্তু দিদি এসে পড়াতেই ক্রমশ ভিড় জমতে শুরু করে। একে একে নেতা, মন্ত্রী, মেয়র, পুরপিতা এবং তৃণমূল সমর্থক।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীই যখন ঘটনাস্থলে রয়েছেন, তখন তাঁদের প্রয়োজন কী? কিছু ক্ষণ পরে মমতাই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘এই তোমরা এখানে কী করছ? মেয়র তুমি মেডিক্যাল কলেজে যাও। স্বপন-পিয়াল তোমরাও যাও। এ দিকটা আমি দেখে নিচ্ছি, ও দিকটা তোমরা দেখ।’’ তার পর লক্ষ্মী সোনা ভাইরা বলে আসা-যাওয়ার রাস্তা খালি করতে পর্যন্ত উদ্যোগী হয়ে পড়লেন দিদি।

তাড়াহুড়োয় আবার কিছু ভুলও হল। মেডিক্যাল কলেজে যে সব মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী নামও ঘোষণা করলেন। কিছু ক্ষণ পরে জানা গেল, তাঁরা আদতে আহত হয়েছেন। সে জন্য এক স্বাস্থ্য কর্তাকে ধমকও খেতে হল। তার পর মাইকে মুখ্যমন্ত্রীই জানিয়ে দিলেন, ‘‘সরি আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছে।’’

গোটা ঘটনা যখন ঘটছে, পাশের চেয়ারে বসে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। গোড়ায় তিনিই ঘোষণা করেছিলেন, নিহতদের পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরে তাঁকে দেখে বোঝা গেল, মুখ্য সচিবের কাজ থেকেও নেই। সবটাই করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী উদ্ধার কাজে যাঁরা নেমেছেন, তাঁদের চা-জল দেওয়ার ব্যাপারটাও তদারকি করছেন দিদিই।

ব্যতিক্রম নয়? রাস্তায় নেমে এ ভাবে বিপর্যয় মোকাবিলার নেতৃত্ব দিতে কবে কোন মুখ্যমন্ত্রীকে শেষ দেখা গিয়েছে? যদিও নিন্দুকেরা আবার ব্যতিক্রমের অন্য দিকটাও দেখছেন। প্রশ্ন তুলছেন, মুখ্যমন্ত্রী না এলে উদ্ধার কাজে গতি আসবে না— এ কেমন কথা?

সে যাক। অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে, এ ধরনের বিপর্যয়ের ঘটনায় ‘মাইক্রো ম্যানেজমেন্টে’ নেমে পড়তে বরাবরই পছন্দ করেন মমতা। তা সে ক্যানিং স্ট্রিটের বহুতল গুদামে আগুন লাগার ঘটনা হোক বা স্টিফেন হাউসের বিপর্যয়, কিংবা আমরিতে আগুন লাগার ঘটনা। সেদিনও হাসপাতালে আগুন লাগার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সামনের ফুটপাথে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন মমতা। বৃহস্পতিবার যেমন কন্ট্রোল রুম খুলে বসেন উড়ালপুলের কাছে।

তবে অনেকেরই মতে, আজকের ঘটনার সঙ্গে ফারাক রয়েছে সে দিনের। শিয়রে ভোট। মমতা বুঝতে পারছেন, তার আগে উড়ালপুল ভেঙে পড়ল বুঝি তৃণমূলের মাথাতেই। কারণ, বিবেকানন্দ উড়ালপুলের বেশিরভাগ কাজ তাঁর আমলেই হয়েছে। তাই দায়ও এসে চাপবে তাঁর ওপর। সব ছেড়ে তাই নিজেই মাঠে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু বিরোধীরাও ছাড়বেন কেন? সরকার যে চাপে পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিরোধীদের। তাই ঘটনাস্থলে মমতার পর পরই সদলবলে উপস্থিত হন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর সমথর্করা আবার মুখ্যমন্ত্রী ও পুরমন্ত্রীর নামে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তোলেন। পরে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান বলেন, ‘‘স্টিফেন কোর্টে আগুন লাগার পরে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সূত্রে আজ তাঁর ইস্তফা দেওয়া উচিত ছিল।’’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র কলকাতায় ছিলেন না। তিনি অবশ্য দলের কর্মীদের নির্দেশ দেন, বিপর্যয়ের ঘটনা নিয়ে যেন কোনও মিটিং মিছিল না হয়। বরং অগ্রাধিকার হল, দ্রুত উদ্ধার কাজ করা। তাঁর নির্দেশে সিপিএম কর্মীরা ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে ক্যাম্প করে রক্তদান করতে নেমে পড়েন। হাসপাতালে গিয়ে আহত-নিহতদের পরিবারের প্রতি সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন সিপিএম কর্মীরা। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নকভি বৃহস্পতিবার কলকাতায় ছিলেন। তিনি আবার দাবি করেন, দিল্লিতে ফোন করে

উদ্ধার কাজে সেনা নামানোর জন্য তিনিই অনুরোধ করেছিলেন। তার পরই সেনা নেমেছে। সেনার পাশাপাশি বিকেলের পর থেকে আর এস এস স্বয়ংসেবকদেরও খাঁকি হাফ প্যান্ট পরে উদ্ধার কাজে হাত লাগাতে দেখা যায়।

কিন্তু বিরোধীদের এ সব ‘রাজনীতি’ বরদাস্ত করতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। অধীর চৌধুরীদের শাসিয়ে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বিকেলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এটা রাজনীতি করার সময় নয়। পহেলে জিন্দেগি, পহেলে রিলিফ।’’ পরে সিপিএম কর্মীদের রক্তদানের খবর কানে যেতে আরও চটে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘রক্ত দেওয়া নিয়ে এতো হুজ্জুতি কেন হচ্ছে? আমাদের যথেষ্ট রক্ত রয়েছে। চাইলে কালকেই এক লক্ষ লোককে রক্ত দানে নামিয়ে দিতে পারি।’’

গভীর রাত পর্যন্ত ঘটনাস্থলে বসেছিলেন মমতা। ব্যবস্থাপনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার বলেন, ‘‘এটা ইলেকশনের ব্যাপার নয়। রাজনীতিও করতে চাইছি না। তবে হ্যাঁ, উড়ালপুলের কাজ কিন্তু শুরু হয়েছিল ওঁদের সময়ে। ওঁরাই টেন্ডার ডেকেছিল। ওঁরাই ঠিকাদার নিয়োগ করেছিল। তাদের দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হয়েছে।’’

আরও খবর:
সিপিএমের রক্ত চলবে না, ক্যাম্প থামিয়ে দিলেন নির্মল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন