তথ্য গোপনের ঝোঁকেই লুকিয়ে ডেঙ্গি-ব্যর্থতা

কলকাতা পুর এলাকায় পুজোর পরে অন্য চেহারায় হাজির হতে পারে ডেঙ্গি। প্রতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করেই এমন পূর্বাভাস দিয়েছিল স্বাস্থ্য ভবন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫১
Share:

প্রতীকী ছবি।

তথ্যেই লুকিয়ে মশাবাহিত রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের চাবিকাঠি। সেই তথ্য সম্পর্কে স্পর্শকাতরতা বিপদ ডেকে আনছে না তো!

Advertisement

আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে দেখে এপ্রিলেই হাবড়াকে সতর্ক করেছিল স্বাস্থ্য ভবন। তাতে কাজ হয়নি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর রাজ্যে এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গিতে মৃত ২৩ এবং আক্রান্ত ৪৫ হাজার। তার মধ্যে হাবড়া, অশোকনগর-সহ কলকাতা সংলগ্ন এলাকার অবদান সব থেকে বেশি।

কলকাতা পুর এলাকায় পুজোর পরে অন্য চেহারায় হাজির হতে পারে ডেঙ্গি। প্রতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করেই এমন পূর্বাভাস দিয়েছিল স্বাস্থ্য ভবন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। ঠিক যেমন এখন তথ্যের নিরিখে পিকনিক গার্ডেন, হালতু, সার্ভে পার্কের একাংশ নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। ডায়মন্ড হারবার স্বাস্থ্য জেলার মগরাহাট, মথুরাপুর এবং কুলপির পরিসংখ্যানও ভাল ঠেকছে না স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের। দফতর সূত্রের খবর, এক সপ্তাহে ওই স্বাস্থ্য জেলায় আক্রান্ত একশো ছাড়িয়েছে।

Advertisement

স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের একটি অংশের মতে, তথ্যকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বাড়ছে বিপত্তি। তাঁদের দাবি, “পুরসভাগুলির কাছে ওয়ার্ড ভিত্তিক আক্রান্তের তথ্য থাকলেও অনেক সময়ে তা পর্যালোচনা হয় না। ওয়ার্ডে আক্রান্ত বাড়লে তবেই পুর কর্তৃপক্ষ ও আধিকারিকেরা নড়ে বসেন। কম হলেও ওয়ার্ডের কোনও একটি পাড়ায় কেন ধারাবাহিক ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তা অনেক সময়ে খেয়াল করা হয় না। মৃত্যুর বিপদ সেখানেই লুকিয়ে থাকে।”

তবে এই পরিস্থিতির জন্য ডেঙ্গি তথ্য নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের স্পর্শকাতরতাও দায়ী বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা। দিল্লিকে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা না পাঠানো এখন যে ঘোষিত নীতি, তা স্পষ্টই জানিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তা। যার প্রেক্ষিতে ইন্ডিয়ান পাবলিক হেল্‌থ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, “একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে, বেশি ডেঙ্গি ধরা পড়ার অর্থ ব্যর্থতা। সব স্তরে এই ধারণা কাজ করায় সমস্যা হচ্ছে। তথ্য জানা থাকলে কোথায় সংক্রমণ বাড়ছে, তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।”

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এক প্রাক্তন কর্তা জানান, স্বাস্থ্য ভবন থেকে আক্রান্তের সংখ্যা পাঠানো হলে তা অনেক সময়ই মানতে চান না পুর কর্তৃপক্ষ। বরং আক্রান্তকে তাঁদের পুর এলাকার বাইরের কোন স্ত্রী এডিস ইজিপ্টাই কামড়েছে, সেই তত্ত্ব খাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্য প্রশাসনের এক কর্তার পর্যবেক্ষণ, “কলকাতা পুরসভায় ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রতিটি পরীক্ষাগারে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন থেকে তা চাইলে বলা হয়, নতুন কিছু নেই। ভাবখানা এমন, রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সেই ধন আছে!’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘তথ্য শুধু পশ্চিমবঙ্গ লুকোচ্ছে না, খবর নিন অনেক রাজ্যই কেন্দ্রকে তথ্য জানাচ্ছে না। তার নিশ্চয়ই কারণ হচ্ছে।’’

তথ্য গোপন বাদে যা পড়ে থাকে তা হল সমন্বয়ের ঘাটতি। তাতে লোকসভা ভোট পরবর্তী বৈশিষ্ট্য হিসাবে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সমন্বয়ের ঘাটতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “যাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন, তাঁরা পুর স্বাস্থ্য বিভাগের অধীন। আবার সাফাই যাঁরা করেন, তাঁরা জনস্বাস্থ্য বিভাগের। দু’টি বিভাগের মেয়র পারিষদ বা চেয়ারম্যান পারিষদ আলাদা হওয়ায় সমন্বয়ের অভাবে সমস্যা হচ্ছে।”

রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য প্রশাসনের এক কর্তার মন্তব্য, “নৈহাটিতে এখন কেস বাড়ছে। দীর্ঘদিন ওখানে পুর স্বাস্থ্য আধিকারিক দফতরে ঢুকে কাজ করতে পারেননি। হাওড়ায় পুরবোর্ড না থাকায় কী করণীয় তা-ই ঠাহর করতে পারছেন না আধিকারিকেরা। হাবড়ায় তো মশা মারতে মন্ত্রীকে মাঠে নামতে হয়েছিল।”

এডিস মারতে কামান দাগার আর বাকি কী রইল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন