চিত্রিত: হাওড়া সেতুতে গুটখার দাপট। বুধবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
মাথা তোলার চার বছরের মধ্যেই দেশের স্বাধীনতা দেখেছে সে। বেঁচেছে জাপানি বোমা থেকে। গুটিগুটি পায়ে তার এখন ৭৫। রাজ্যজুড়ে পরপর সেতু ভাঙার জমানায় উন্নতশির, অবিচল হাওড়া সেতু। ১৯৬৫ থেকে যার ভাল নাম রবীন্দ্র সেতু। তবে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আর কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সেতুর রক্ষক কলকাতা বন্দর। গড় বাঙালির মতো এ ক্ষেত্রেও ডাক পড়েছে দক্ষিণী ডাক্তারবাবুর! চেন্নাই আইআইটি-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাওড়া সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার। সেই কাজ শুরুও হয়েছে।
বন্দরের চেয়ারম্যান বিনীত কুমারের কথায়, ‘‘হাওড়া সেতু আর কলকাতা সমার্থক। তাই এই সেতুকে সুস্থ-সবল রাখা আমাদের দায়িত্ব। রং করা এবং মরচে ধরতে না দেওয়াই এই সেতুকে বাঁচিয়ে রাখার মূল মন্ত্র। চেন্নাই আইআইটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যা বলবে, তা করা হবে।’’
বন্দর সূত্রের খবর, ২০১১ সালে দুই গবেষক সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছিলেন। তাতে দেখা যায়, ৭৫ বছরের তরতাজা সেতু গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র গুটখার দাপটে কাহিল হয়ে পড়েছে। সেতুর দু’দিকে ৩৯টি করে মোট ৭৮টি ‘হ্যাঙার’ রয়েছে। ছোট ছোট ইস্পাতের পিলারের মতো এই হ্যাঙারই সেতুর ডেককে মূল পিলারের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে।
আরও খবর: অনেক দিনের ‘ক্লান্তি’ অসহ্য হতেই মাঝেরহাটে এই বিপর্যয়!
গবেষণায় বেরোয়, গুটখার দাপটে ৬ মিলিমিটার পুরু হ্যাঙারগুলির ৩ মিলিমিটার পর্যন্ত ক্ষয়ে গিয়েছে। কারণ, ইস্পাতের সঙ্গে গুটখা মিশ্রিত ‘অ্যাসিডিক’ থুথু প্রায় খতম করে দিচ্ছিল সেতুকে।এর পরেই প্রতিটি হ্যাঙারের গোড়া ফাইবার গ্লাস দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। তবে গুটখার সঙ্গে পাখির বিষ্ঠাও সেতুর স্বাস্থ্যে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। তা রুখতে পাশাপাশি দু’-তিন বছর অন্তর জিঙ্ক ক্রোমাইটের প্রাইমারের উপরে অ্যালুমিনিয়াম রং দেওয়া হয় বলে জানাচ্ছেন বন্দরকর্তারা। এক বার রং করতে প্রায় ২৭ হাজার লিটার রং লাগে। খরচ হয় কোটি টাকা। তবে বছরে গড়ে আড়াই কোটি খরচ ধরাই থাকে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে। অথচ ৭৫ বছর আগে ওই টাকাতেই নির্মিত হয়েছিল হাওড়া সেতু।
আরও খবর: রেলকে খোঁচা মমতার, পাল্টা যুক্তি রেলেরও
বন্দরের নথি জানাচ্ছে, ১৯৩৭-এ নির্মাণ শুরু হয়েছিল এই সেতুর। শেষ হয় ১৯৪২-এর অগস্টে। ১৯৪৩-এ ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্য রাতে কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত একটি ট্রাম চালিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছিল। যে সেতু তৈরি হতে মাত্র পাঁচ বছর লেগেছিল, সেই সেতুর পরিকল্পনা হয়েছিল ৩০ বছর ধরে। ঠিক কোন প্রযুক্তিতে সেতুটি নির্মাণ করা হবে, তা ঠিককরতে পারছিলেন না ব্রিটিশরা। রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর কলকাতা বন্দরের চিফ কমিশনারের মধ্যে সেতুর প্রযুক্তি নিয়ে লড়াই বেধেছিল। বন্দর চাইছিল, আগেকার ভাসমান সেতুর মতোই আরও একটি সেতু। যার মাঝখানটা খোলা যাবে, যে পথে যাতায়াত করবে জাহাজ।অন্য দিকে, রেলের ইঞ্জিনিয়ারেরা ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তির সেতুর কথা বলছিলেন। শেষ পর্যন্ত ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তির সেতুতেই সিলমোহর দেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু দুই ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের বিবাদ মেটাতে তৎকালীন সরকার বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার তথা মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক রাজেন্দ্রনাথ (আরএন) মুখার্জিকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গড়ে দেয়। ১৯২২ সালে সেই মুখার্জি কমিটি ক্যান্টিলিভার সাসপেনশন সেতুর সুপারিশ করে। তার পরে ১৯২৬-এ পাস হয় ‘দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’। খরচ ধার্য হয় ২ কোটি ৪২ লক্ষ ৬০ হাজার ৯৬০ টাকা।
বন্দরের দাবি, এখন সপ্তাহের কাজের দিনে গড়ে সওয়া এক লক্ষ গাড়ি চলাচল করে এই সেতু দিয়ে। যাতায়াত করেন ৫ লক্ষ পথচারীও। ১৯৪৭-এ সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার মোটরগাড়ি চলত। আর চলত গরুর গাড়ি।
কিন্তু আর কতদিন এ ভাবে চলবে?
বন্দর কর্তাদের দাবি, হাওড়া সেতু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার সাসপেনশন সেতু। রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক থাকলে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ১৯১৭-এ একই প্রযুক্তির কানাডার পঁ দ্য কেবেক সেতু ভেঙে পড়েছিল। অন্যগুলি ‘কর্মক্ষম’ রয়েছে এখনও। বন্দরের চেয়ারম্যান জানান, একই প্রযুক্তিতে নির্মিত মুম্বইয়ের কারন্যাক সেতু ১৪৭ বছর পরে ‘নিরাপদ নয়’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। হ্যানকক সেতুও ১৩৭ বছর পরে ভেঙে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু হাওড়া সেতু তো সবে ৭৫!