বিয়ের দিন অনন্যা ও অর্ণব।
স্নাতকোত্তর স্ত্রী চাকরি পাননি। ন’মাসের সংসারে তা ঘিরে প্রায়ই চলত অশান্তি। যত দিন না চাকরি পাচ্ছেন স্ত্রী, ততদিন সন্তানের কথাও ভাবা যাবে না— এমনই ছিল শর্ত।
শুক্রবার, অনন্যা কোনার সাঁই (২৭) নামে এক তরুণীর মৃত্যুর পরে এমনই অভিযোগ সামনে এল। মৃতার পরিবারের অভিযোগ, বধূ নির্যাতন ও পণের চাহিদাই মৃত্যুর কারণ। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই অনন্যার স্বামী, গড়িয়ার সারদা পার্কের বাসিন্দা অর্ণব সাঁইকে গ্রেফতার করেছে বাঁশদ্রোণী থানার পুলিশ। যদিও কী ভাবে পণ চাওয়া হয়, তা নিয়ে কিছু জানাননি অনন্যার পরিজনেরা।
আরও পড়ুন: এ-ও যেন রেকারিং পণের দাবি
এই ঘটনাই ফের উস্কে দিয়েছে উত্তরপাড়ার পারমিতা বক্সীর স্মৃতি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সেই তরুণীর দেহ উদ্ধারের পরে মিলেছিল একটি সুইসাইড নোট। সেই চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল, পুণেতে কর্মরতা ওই তরুণী চাকরি ছেড়ে বেঙ্গালুরুতে স্বামীর সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাকরির জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হত। সেই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পারমিতা।
অনন্যার ঘটনাতেও একটি চিঠি উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেই চিঠিতে ওই তরুণী তাঁর মাকে লিখেছেন, চাকরি করার জন্য নিয়মিত মানসিক অত্যাচার চালানো হত তার উপরে। এমনকী অর্ণব তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি মা হতে পারবেন না। চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, ফি দিনের অপমান তাঁর কাছে খুবই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।
শনিবার অনন্যার পরিবার জানায়, ২ মার্চ অনন্যার সঙ্গে এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী অর্ণবের বিয়ে হয়। বর্ধমানে বা়ড়ি থাকলেও কর্মসূত্রে বছর দেড়েক ধরে গড়িয়ার সারদা পার্কেই থাকছিলেন অর্ণব। বিয়ের পরে অনন্যাও সেখানে থাকতেন। বোটানিতে স্নাতকোত্তর অনন্যা বি.এড কোর্সও করেছিলেন। শিক্ষকতার চাকরি জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি।
এ দিন অনন্যার মা রূপালি কোনার জানান, বিয়ের পর থেকে চাকরির জন্য চাপ দেওয়া হত অনন্যাকে। এ কথা অনন্যা মাকেও জানিয়েছিলেন। রূপালিদেবীর কথায়, ‘‘ও বলত ওর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অর্ণব। বলে, বাড়ি বসে থাকলে চলবে না। চাকরির চেষ্টায় বাইরে যেতে হবে।’’ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অনন্যার বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক বীরেন্দ্র কোনার তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, একটু সময় নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে অনন্যার মাসিক হাত খরচও বাড়িয়ে দেবেন তিনি। কিন্তু তাঁদের দাবি, তার পরেও অনন্যা বারবার বলতেন, চাকরি না পেলে তাঁর চলবে না।
রূপালিদেবী জানান, শুক্রবার সকালে অর্ণব তাঁকে ফোন করে বলেন, তাঁদের মেয়ে মারা গিয়েছেন। এর পরে তাঁরা গিয়ে দেখেন, গলায় ওড়না জড়ানো অবস্থায় পড়ে তাঁদের মেয়ের দেহ। এর পরে পুলিশ দেহ উদ্ধার করে ময়না-তদন্তে পাঠায়। শুক্রবার দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পরে রাতে অর্ণবকে গ্রেফতার করা হয়।
এ দিন বাঁশদ্রোণী থানার পুলিশ অর্ণবকে আলিপুর আদালতে হাজির করায়। পুলিশ আদালতে জানিয়েছে, অনন্যার মৃত্যুর কারণ জানতে তাঁকে তারা ১৪ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে রেখে জেরা করতে চায়। অর্ণবের আইনজীবী জয়দীপ ঘোষ ও অভিষেক চক্রবর্তী আদালতে অর্ণবের জামিনের আবেদন করেন। আইনজীবীরা জানান, এটি আত্মহত্যা। পুলিশ ও অর্ণবের আইনজীবীর বক্তব্য শুনে বিচারক ধৃতকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন।
গ্রেফতারের পরে আদালতের পথে মৃতার স্বামী অর্ণব সাঁই। শনিবার।
এ দিন অর্ণবের মা তন্দ্রা সাঁই জানান, অনন্যা চাকরি করতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁকে কোনও রকম চাপ দেওয়া হয়নি। সাঁই পরিবারের দাবি, অনন্যা আত্মহত্যা করেছেন।
সারদা পার্কের বাসিন্দাদের সূত্রে খবর, ২০০১ সালে ওই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন অর্ণবের বাবা সন্দীপ সাঁই। পড়াশোনার জন্য তাঁর দুই ছেলে মাঝেমধ্যে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন। অর্ণব চাকরি পাওয়ার পর থেকে পাকাপাকি ভাবে সেখানে থাকতে শুরু করেন। এ দিন সেটি তালা বন্ধ ছিল। ওই ফ্ল্যাটের কিছু দূরেই একটি বাড়িতে সপরিবার থাকেন তাঁর দাদা অয়ন সাঁই। অনন্যার পরিবারের অভিযোগের প্রসঙ্গে পেশায় চিকিৎসক অয়নবাবু বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে মেয়ের বাড়ির লোকেরা অনেক কিছু বলেন। আমরা কিছু বলব না। পুলিশ তদন্ত করছে।’’
—নিজস্ব চিত্র