বিক্ষোভ: বিধায়কদের গ্রেফতারির প্রতিবাদ তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের। সোমবার, এ জে সি বসু রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
এটা কি সঙ্কটের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে? না কি, ইচ্ছে করেই অতিমারির মোকাবিলায় রাজ্যের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রয়াস?
প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ হওয়া বাংলায়। পাঁচ বছর আগে ওঠা অভিযোগের তদন্তে পদক্ষেপ করার এটাই কি ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ? অন্যায়ের মোকাবিলায় সিবিআই লেলিয়ে এ কেমন সুচিন্তিত সময় নির্বাচন?
ভোট-পরবর্তী, অতিমারি-ধ্বস্ত বাংলায় পুরনো কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রীদের গ্রেফতারি এখন সমাজমাধ্যম বা জনসমাজের নানা স্তরেই চর্চার বিষয়। বিধিনিষেধের ধাক্কায় জীবন ও জীবিকায় রাশ টেনে যখন করোনা মোকাবিলায় পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা, তখনই কেন্দ্রের ইন্ধনে শহর কলকাতায় সংঘটিত হচ্ছে মারণ রোগ ছড়ানোর ‘সুপারস্প্রেডার ইভেন্ট’।
ভোটের আগে জনসভা বা ভোটকালীন গোলমালের নানা বিশৃঙ্খলার ছবিটাই যা ফের উস্কে দিচ্ছে। “এক মাস জুড়ে টানতে থাকা ভোটের সময়ে যা মনে হয়েছিল, এখন ঠিক সেটাই মনে হচ্ছে”, বলছিলেন টালিগঞ্জের গৃহবধূ তিথি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “কেন্দ্রের শাসক দল বাংলায় জিততে মরিয়া হলেও বাংলার মানুষের জীবন নিয়ে ভাবে না! একটা মারণ-সঙ্কটে ইচ্ছে করে সব কিছু টালমাটাল করার চেষ্টা চলছে।”
লেক টাউনের বাসিন্দা, চিকিৎসক সত্যপ্রিয় দে সরকারও স্তম্ভিত: “তা হলে অগ্রাধিকারের তালিকায় অতিমারির সঙ্কটটাই পিছনে। নইলে পাঁচ বছরের পুরনো কেলেঙ্কারিকে খুঁড়ে আনার কারণটা কী?” তাঁর মতে, “যাঁদের ধরা হল, তাঁরা কেউ সন্ত্রাসবাদী নন, কেউ পালাচ্ছিলেন না। বেছে বেছে করোনা-যুদ্ধের সময়ে তাঁদের ধরা ও রাস্তাঘাটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি— এ তো উল্টে সংক্রমণ ছড়াবে।” কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের হার বাড়ছে বাংলায়। এই সময়ে প্রতিষেধক সরবরাহ বা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রাজ্যকে আরও বেশি করে সাহায্য করাই কেন্দ্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বলে সকলের অভিমত।
অনেকেরই মতে, ভোটে হেরে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মেটানো বা ঝিমিয়ে পড়া কর্মকর্তাদের চাঙ্গা করার চেষ্টা হিসেবেও এই পরিস্থিতিকে দেখা যায়। কারও বক্তব্য, এ তো উপনিবেশ চালানোর ঢঙে দেশ চালানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি চরম উপেক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি।
পঞ্চাননতলার বাসিন্দা, পেশায় গৃহ পরিচারিকা তাপসী ময়রা বা বড়বাজারের তেল-সাবানের পাইকারি ব্যবসায়ী স্বপন পালও কার্যত একমত। তাপসী বলছিলেন, “যাঁরা অন্যায় করেছেন, তাঁরা শাস্তি পান। কিন্তু গ্রেফতারের এটা সময়? কেউ তৃণমূলের সমর্থক না-হলেও বাংলার মানুষের প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন।” জোড়াবাগানের বাসিন্দা স্বপনবাবু এ দিনই প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নিতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। ক্ষুব্ধ স্বরে বলছিলেন, “ব্যবসা চৌপাট। বাড়িতে অসুস্থ মা, বৌ, ছেলে কারও ভ্যাকসিন জোটেনি। চেনা-জানা কত মুটে-মজুরের ভাত জোটার নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় রাজ্যে ইচ্ছে করে যারা অশান্তি করছে, তারা কি মানুষ! এই নিষ্ঠুরতাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।”
প্রতিদিনই মৃত্যুর একের পর এক খবরে অনেকেই ভয়ে সমাজমাধ্যমে ঢুকছেন না। অচেনা তরুণ-তরুণীর ছবি দেখলেও দুঃসংবাদ ভেবে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠছে অনেকের। অক্সিজেন-সঙ্কট বা হাসপাতালে শয্যার আকালে যখন হাহাকার চলছে, তখনই নিজাম প্যালেস বা রাজভবনের সামনে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। তিথি বলছিলেন, “আমার ছেলে অফিসে বেরোয়। ওর সমবয়সি এক বন্ধুর মৃত্যুর খবর সদ্য পেয়েছি। এ সব রাজনৈতিক অশান্তিতেও তো কম বয়সিরাই রাস্তায় নামে। তারা ক’জন ভ্যাকসিন পেয়েছে? সরকারের কাছে কি তাদের জীবনের দাম নেই?”
তবে, চরম হতাশাতেও বাঙালির রসিক মন মরেনি। শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়েরা কোন ‘ভ্যাকসিনে’ সিবিআইয়ের কাছে ‘ছাড়’ পেলেন, সেটাও আলোচনার বিষয় হয়ে রইল।