হতাশার গ্রাস।ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
খান স্যুটের পেটের কাছে পকেটে এখনও এক তাড়া বাতিল পাঁচশো-হাজারের নোট। কাবুলের দক্ষিণে পাকতিকা প্রদেশের মহম্মদ নবি বলেন, ‘‘আমি ‘রিপুজি’ (শরণার্থী) আদমি! সবে একটু গোছাতে পেরেছি। হঠাৎ যে এমনটা ঘটবে, ভাবতেই পারিনি!’’
বাতিল নোটের সঙ্গেই রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী পরিচয়পত্র। মাস কয়েক আগে দিল্লি গিয়ে যা ‘রিনিউ’ করিয়ে আসতে হয়েছে। দু’হপ্তা আগে দিল্লি থেকে আসা একটি নির্দেশেই গুটিকয়েক আফগান-পাখতুনি বংশোদ্ভূতের সুদের কারবার রাতারাতি ধসে গিয়েছে।
এক ছাদের নীচে মহম্মদ নবির পড়শি মুসা খান, ফজুল রহমানরাও। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যাঁরা রীতিমতো হাহাকার করছেন। নগদ ধার দিয়ে সুদ বাবদ হেসেখেলে ৬০-৭০ হাজার হাতে আসত মাসে!
ঠিক দু’টো মঙ্গলবার আগে, ৮ নভেম্বর রাতের পর থেকে বকেয়া টাকা আদায় কার্যত তলানিতে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে পড়ে থাকা পরিজনেদের কথা ভেবে দীর্ঘদেহী টকটকে চেহারার অবয়বগুলো যেন বাজ পড়া মুখে থম মেরে রয়েছে।
বৌবাজারের চাঁদনি চক পাড়ার তস্য গলি গুমঘর লেন। সেখানে ‘খান কোঠি’ কে না-চেনে! স্যাঁতসেঁতে উঠোন, ভাঙাচোরা সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরটায় ঢুকলে কোনও কোঠিসুলভ প্রাচুর্যের ছিটেফোঁটা নেই। ধুলো জমা ম্লান সবুজ কার্পেটের কিনারে দেওয়াল-ঘেঁষা তালাবন্ধ সিন্দুক। কিছু দিন
আগেও সন্ধ্যায় চেনা-অচেনা আগন্তুকের ভিড় লেগে থাকত। এখন সব বন্ধ। দাদা-পরদাদার আমল থেকে চালু সাবেক মহাজনি কারবারটার ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন গজগজ করছে।
পাখতুনি ফজুল রহমান বা কাবুলি মুসা খানরা অবশ্য ভারতীয় নাগরিক এখন। আগের প্রজন্মের হাত ধরে কয়েক দশক আগে এই ‘কলকাত্তার মিট্টি’তে তাঁদের মিশে যাওয়া। এই নানা কিসিমের সরকারি-বেসরকারি ঋণের যুগেও ‘কাবুলিওয়ালা’দের দরকার ফুরোয়নি। আপদে-বিপদে মানুষের নানা দরকার, কারও হঠাৎ ডাক্তার-বদ্যির প্রয়োজন থেকে সহায়সম্বলহীনের ছোটখাটো ব্যবসায় লগ্নির জন্য ওঁরা এখনও বহু মানুষের বল-ভরসা। মুসার কথায়, ‘‘আমাদের বেঁচে থাকার আসল পুঁজি হল মানুষের প্রতি বিশ্বাস। লোকেও মানত, মোটে তিন-চার-পাঁচ পার্সেন্ট সুদে আর কে টাকা ধার দেবে!’’ ফজুল বলছিলেন, ‘‘অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়ীকেই দেখছি, কারবার একেবারে তলানিতে! এই অবস্থায় ওঁরাই বা কী ভাবে টাকা দেবেন? কবে দেবেন, খোদাই বলতে পারবেন!’’
এই অনিশ্চয়তায় কাবু বেহালার তাজ মহম্মদ খান বা মল্লিকবাজারের দাদগোল খানেরাও। বাঙালি বৌ নিয়ে এ শহরেই তাঁরা সংসার পেতেছেন। কিন্তু সাবেক সুদের কারবারই তাঁদেরও রুটিরুজি। বাজারে অনেকেরই ১৫-১৬ লক্ষ টাকা প্রাপ্য বকেয়া। গুমঘর লেনের ঘরে কাবুল থেকে আসা দেশতুতো ভাই-বেরাদরদের পাঠানো কাঠবাদাম-পেস্তা খেতে খেতে বা গ্রিন টিয়ে চুমুকের ফাঁকে দীর্ঘশ্বাস ঘনিয়ে ওঠে।
সব থেকে বেশি দুশ্চিন্তা নবির। মহাজনি কারবারে এখনও পোক্ত হতে পারেননি ঘরছাড়া প্রৌঢ়। মুলুকে থাকাকালীন হাতসাফাইয়ের কসরতে ‘ম্যাজিক’ দেখাতেন বলে তালিবানদের বিষনজরে পড়েন তিনি। পায়ে গুলিও খেয়েছেন।
চার বছর আগে বাধ্য হয়েই ভিসা জোগাড় করে ‘ইন্ডিয়া’ চলে আসেন। তার পরে দিল্লিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী পরিচিতি জোগাড় করে জীবনযুদ্ধে সামিল।
বর্ধমানের কাছ থেকে তৈরি করানো কাবুলি পাগড়ি, জরির কাজ করা শাড়ি, সালোয়ার স্যুট, বড়বাজারের আতরের পসরা নিয়ে কলকাতা-শিলিগুড়ি ঘুরে বেড়ান নবি। অল্প সুদে দু’পাঁচ হাজার টাকা ধারও দেন। আর হিসেব কষেন, ঠিক কত জমলে বিবি-বাচ্চাদের এ দেশে নিয়ে এসে সংসার জোড়া লাগবে।
পুশতু টানের হিন্দিতে তিনি বলছিলেন, ‘‘এত দিন কেউ কাবুলে গেলে পাঁচ-সাত হাজার যা পেরেছি, বিবি-বাচ্চাদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত নেই। বাতিল নোটের জমানো টাকাগুলো কী করব বলতে পারেন?’’ এ পাড়ার বাওল খান কিছু দিন আগেই দেশে ফিরে গিয়েছেন। সব টাকা তাঁর হাত দিয়ে কেন পাঠিয়ে দিলেন না, ভেবে হাত কামড়াচ্ছেন নবি।
এই নোটের চোটে হঠাৎ সব অনিশ্চিত। চার বছরের মেয়ে সায়রার মুখটা কবে দেখবেন, জানেন না এই কাবুলিওয়ালা।