জঞ্জাল জমে আছে প্রিন্স গুলাম হুসেন শাহ রোডের সেই এলাকায়। নিজস্ব চিত্র
সরাসরি না হলেও গাফিলতির অভিযোগ প্রকারান্তরে মেনেই নিল কলকাতা পুরসভা। ডেঙ্গি মোকাবিলায় মশা মারার ক্ষেত্রে পুরকর্মীরা যে যথেষ্ট সক্রিয় নন, বহু দিন ধরেই বারবার সেই অভিযোগ উঠছিল। সম্প্রতি যাদবপুর থানা এলাকার এক বস্তিতে দু’জনের মৃত্যুর পরে ওই অভিযোগ আরও জোরদার হয়। তার পরেই কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে পুর স্বাস্থ্য দফতরের চার অফিসারকে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরালেন পুর কর্তৃপক্ষ।
পুরসভা সূত্রে খবর, চলতি সপ্তাহে পুরসভার ৯৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় দু’জনের মৃত্যুর ঘটনায় বিব্রত পুর প্রশাসন। স্থানীয় মহলে অভিযোগ উঠেছে, জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজে ঢিলেমির কারণেই ওই এলাকায় ডেঙ্গিবাহী এডিস ইজিপ্টাইয়ের দাপট বেড়েছে। পুর প্রশাসনের খবর, যেখানে জঞ্জাল জমে রয়েছে, সেটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হলেও পুর আইন অনুযায়ী সেখানে সাফাইয়ে তৎপরতা দেখাননি ওই বরো এবং ওয়ার্ড এলাকার মেডিক্যাল অফিসার ও পতঙ্গবিদেরা। সেই কারণেই তাঁদের শো-কজ করা হয়েছে বলে শনিবার জানান পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ। অর্থাৎ, ওই এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য পুর পরিষেবা না মেলাই যে অন্যতম কারণ, চার জনকে শো-কজ করার মাধ্যমে প্রকারান্তরে তা মেনে নিল পুরসভা।
পুরসভা সূত্রের খবর, গত ৫ এবং ৭ নভেম্বর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর থানা এলাকার প্রিন্স গুলাম হুসেন শাহ রোডের এক বস্তির বাসিন্দা বিনোদ চৌধুরী ও দিশা বর্মণের মৃত্যু হয়। দু’জনের রক্তেই এনএস-১ পজিটিভ মিলেছিল। এবং সেই পরীক্ষা হয়েছিল পুরসভার ক্লিনিকেই। পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক এ দিন জানান, নিয়ম অনুযায়ী পুর ক্লিনিকে রক্ত পরীক্ষায় এনএস-১ পজিটিভ ধরা পড়লেই রোগী যে এলাকায় থাকেন, সেখানে মশাদমন বাহিনী পৌঁছে যায়। এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেঙ্গিবাহী মশা মারার কাজ করে তারা। বিনোদ চৌধুরীর রক্তে ডেঙ্গির প্রাথমিক সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩ নভেম্বর। সে দিনই ওই এলাকায় চলে যায় পুরসভার দল। পুর স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, ৩ এবং ৪ নভেম্বর সেখানে কাজও করেন পুরকর্মীরা। আর ৫ তারিখ মৃত্যু হয় বিনোদবাবুর। দিশা মারা যান ৭ নভেম্বর। পরপর দু’জনের মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ে ওই বস্তি এলাকায়। তার পাশেই রয়েছে একটি কারখানা। অভিযোগ, সেখানে জমে থাকা জঞ্জাল থেকেই মশার উপদ্রব বেড়েছে। তা দেখেও কেন পুরসভার কর্মী-অফিসারেরা নীরব থেকেছেন, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই। এমনকি, এলাকাবাসীর ক্ষোভ স্থানীয় কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ রতন দে’র বিরুদ্ধেও। বিক্ষোভ বাড়তেই শুক্রবার তড়িঘড়ি এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় পুর প্রশাসন। দীর্ঘদিন জমে থাকা জঞ্জাল সরানোর কাজেও হাত দেয় পুরসভার দল।
আরও পড়ুন: সরকারি স্টিকার লাগিয়ে পথে বেসরকারি বাস, তদন্তের নির্দেশ
কালীপুজো-দীপাবলি-ভাইফোঁটা মিলিয়ে পাঁচ দিন ছুটি থাকার পরে এ দিনই খুলেছে পুরসভার দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের পদস্থ অফিসারদের নিয়ে এ দিনই বৈঠক করেন অতীনবাবু। পরে তিনি জানান, বেসরকারি কোনও জায়গায় জঞ্জাল জমে থাকলে তা নিয়মিত পরিষ্কার করার দায়িত্ব যেমন পুরসভার নয়, তেমন এটাও ঠিক যে, ডেঙ্গির মতো রোগ নিবারণের কাজে নতুন আইন হয়েছে পুরসভায় (৪৯৬এ)। ওই আইনের বলে সংশ্লিষ্ট জায়গার মালিকের বিরুদ্ধে নোটিস দেওয়া যায়। তাতেও কাজ না হলে ওই জায়গা থেকে জঞ্জাল সরানোর কাজ করার কথা পুরসভার। যার খরচ বহন করতে হবে জায়গার মালিককে। অতীনবাবু বলেন, ‘‘সেই কাজে গাফিলতি ছিল ওই বরোর হেল্থ এগজিকিউটিভ, পতঙ্গবিদ, ওয়ার্ড মেডিক্যাল অফিসার এবং ভেক্টর কন্ট্রোল ইন-চার্জের। তাই তাঁদের শো-কজ করা হয়েছে।’’
একই সঙ্গে তাঁর আবেদন, ‘‘জনস্বাস্থ্যের কাজে শুধু পুরসভাকে দায়ী করা ঠিক নয়। এলাকার বাসিন্দাদেরও সজাগ থাকতে হবে।’’ তাঁর অভিযোগ, যাদবপুরের ওই কারখানায় বাইরে থেকে এসে কেউ জঞ্জাল ফেলে যায় না। এলাকার বাসিন্দারাই ফেলেন। তাই তাঁদেরও সচেতন হতে হবে। তিনি জানান, মৃত দু’জনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে তাঁদের রক্ত নাইসেডে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই পুরসভার ক্লিনিকে তাঁদের রক্তের আইজিজি পরীক্ষা করানো হয়েছে। তাতে বিনোদবাবুর রক্তে আইজিজি পজিটিভ মেলায় তাঁর ডেঙ্গ-২ টাইপ হওয়া নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে। পুরসভার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তপনকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাত্র দু’-তিন দিনের জ্বরে দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। যা ডেঙ্গ-২ হলেও হতে পারে।’’ অতীনবাবু জানান, ওই পরীক্ষা পুরসভায় নতুন শুরু হয়েছে, তাই আরও নিশ্চিত হতে বিশেষজ্ঞ সংস্থা নাইসেডের কাছে ফের রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছে। তবে যাদবপুরের ওই বস্তি এলাকায় ডেঙ্গির সংক্রমণ শীতের মুখে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পুর প্রশাসনকে। প্রশ্ন তুলে দিয়েছে পুরসভার ‘বছরভর সজাগ’ থাকার বার্তা নিয়েও।