বড় অশান্তি ছাড়াই দমদমে ‘ভোট শিল্প’

যদিও ভোট ‘শান্তিপূর্ণ’ কি না, সেই সংশয় তৈরি করেছে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পুর এলাকার বেশ কিছু বুথের ঘটনা।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৯ ০১:৪৯
Share:

সারিবদ্ধ: বাগুইআটির সাত নম্বর ক্যাম্পে ভোটের লাইন। রবিবার। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

ভোটগ্রহণ তখনও শুরু হয়নি। তার আগে থেকেই বুথের বাইরে দীর্ঘ লাইন। ইভিএম বিভ্রাট বা বিরূপ আবহাওয়া সেই লাইন সঙ্কুচিত করতে পারেনি। বড় কোনও গোলমালের খবরও নেই। ঘাম ঝরানো গরমে দমদম লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনে যা পড়ে রইল, তা শাসকের পরিভাষায় ‘ভোট শিল্প’। সেই ‘ভোট শিল্প’ সম্পর্কে বিরোধীরা যে খুব বিচলিত তা নয়। বেলাশেষের বৃষ্টিতে বিরোধী স্বরও বলছে, ভোট হয়েছে মোটের উপরে ‘শান্তিপূর্ণ’।

Advertisement

যদিও ভোট ‘শান্তিপূর্ণ’ কি না, সেই সংশয় তৈরি করেছে দমদম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পুর এলাকার বেশ কিছু বুথের ঘটনা। যেমন, দক্ষিণ দমদমের ঘুঘুডাঙার ২২০ নম্বর বুথে বিজেপির এজেন্ট ছিলেন বাপ্পা রায়। তাঁর অভিযোগ, সকাল পৌনে ছ’টা নাগাদ তিনি বুথে যাওয়ার সময়ে বাউল বেকারি মোড়ের কাছে শাসক দলের কর্মীদের একাংশ পথ আটকে তাঁকে মারধর করেন। বেলার দিকে যখন বিধান কলোনিতে বাপ্পার বাড়ি পৌঁছনো গেল, তখনও তাঁর স্ত্রী সোনালি রায়ের চোখে-মুখে আতঙ্ক। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দেখে বুথে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন বিজেপির ওই কর্মী। পাশ থেকে সোনালি বলেন, ‘‘ভোট দিতে গেলে আবার যদি মারে! ওরা বাড়ি এসে শাসিয়ে গিয়েছে।’’

একই ভাবে পূর্ব সিঁথির বিদ্যুৎচক্র পাঠাগারের ২২৩, ২২৪, ২২৫ ও ২২৬ নম্বর বুথে আসার পথে সিপিএম এজেন্টদের আটকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সেই অভিযোগের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে দাগা কলোনি, তানওয়ার কলোনির বেশ কিছু বুথ ঘিরে। রাষ্ট্রগুরু অ্যাভিনিউয়ে ভোটারদের বুথে আসতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। বিকেলে এজেন্টদের খাবার দেওয়ার সময়ে মহিলা-সহ স্থানীয় সিপিএম সমর্থকদের তৃণমূলের বাইক বাহিনী মারধর করে বলে অভিযোগ। যার জেরে এক সময়ে বুথ থেকে এজেন্টদের চলে যাওয়ার ‘পরামর্শ’ দেন স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব। পাশাপাশি, রাজারহাট-গোপালপুরের ১৭১, ১৭২ এবং ১৭৩ নম্বর বুথে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে সিপিএম। দমদমে যে এই ‘ভোটশিল্পে’র দেখা মিলেছে, তা স্বীকার করে সেখানকার বাম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কিছু বুথ দখল হয়েছে। দুপুরের পরে ভুয়ো ভোট বেশি হয়েছে। সেটা চোখে পড়ার মতো পর্যায়ে গিয়েছে দমদমে।’’ বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ভোটের আগের রাতে বেশ কিছু জায়গায় আমাদের এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।’’

Advertisement

শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের বৃত্তে রয়েছে কংগ্রেসও। তাদের অভিযোগ, মতিঝিলে কে কে হিন্দু অ্যাকাডেমি স্কুল, বান্ধবগড়ে বুথের লাইনে ভুয়ো ভোটার দাঁড় করানো হয়েছিল।

বিরোধীদের বক্তব্য, গোলমালের খবর পেয়ে কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি) হাজির হয়েছে। তখনকার মতো পরিস্থিতি শান্ত হলেও তারা ফিরে যাওয়ার পরে আবার যে-কে-সেই। কেষ্টপুরের মাস্টারদা স্মৃতি সঙ্ঘ ক্লাবে কংগ্রেসের এজেন্ট সমীর রায় অভিযোগ করেন, স্থানীয় কাউন্সিলরের বাইক-বাহিনী তাঁকে বুথ থেকে সরানোর চেষ্টা করেছে। ওই বুথের কাছে আর একটি বুথে সিপিএমের পোলিং এজেন্টকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে ছুটে আসেন সেক্টর অফিসার। সে সময়েই তাঁর কাছে ফোন আসে, উদয়নপল্লি সাত নম্বর ক্যাম্পে গোলমাল হচ্ছে। তা শুনে তিনি সেখানে যান। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চার দিকে দৌড়চ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দৌড় করিয়ে আসল কাজটা হাসিল করে নেওয়া হচ্ছে না তো?’’ ওই যে ‘ভোটশিল্প’।

এমন ছবি আরও রয়েছে। দক্ষিণ দমদম পুরসভার এক কাউন্সিলরকে আরজেডি প্রার্থীর নামাঙ্কিত কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। কারণ জানতে চাইলে খোলাখুলি তিনি বলেন, ‘‘ওটা আমি এমনিই কেড়ে নিয়েছি।’’ এই আবহে উত্তর দমদমের সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শাসক দলের লোকজন বেশ কিছু জায়গায় আমাদের এজেন্টদের হুমকি দিয়ে বলেছে, বুথে থাকলে ৫০-১০০টা ভুয়ো ভোট দিতে হবে। রাজি না হলে পোলিং এজেন্টদের বার করে দেওয়া হয়েছে।’’

বিরোধীদের এই অভিযোগ প্রসঙ্গে তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় বলেন, ‘‘সিপিএম-বিজেপি এজেন্ট দিতে না পারলে সেটা আমাদের দোষ? এ সব নিয়ে কেউ কি কোনও অভিযোগ করেছেন?’’ তবে একটি বিষয়ে তিন জনই সরব। তা হল, ইভিএম বিভ্রাট এবং তাঁর জন্য মানুষের দুর্ভোগ। সৌগত বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা চোখে পড়েছে। কামারহাটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে কেন্দ্রীয় বাহিনী আমাদের ক্যাম্প ভেঙেছে। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডেও বিনা প্ররোচনায় মেরেছে।’’

এ সব বাদ দিলে আগামী বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশের দিন প্রসঙ্গে সৌগত বলেন, ‘‘মানুষ এই গরমে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। রিগিং তো হয়নি। বৃহস্পতিবারই বোঝা যাবে, জনগণ কী রায় দিয়েছেন।’’ নেপালদেব বলেন, ‘‘কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা ব্যাপক বললে মিথ্যা বলা হবে।’’ আর শমীকের কথায়, ‘‘একটা সঙ্কল্প নিয়ে মানুষ ভোট দিয়েছেন। ইভিএম বিভ্রাট সত্ত্বেও লাইনে আড়াই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। সেই অপেক্ষা কাদের জন্য ছিল দেখা যাক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন