মানিকতলা হত্যা রহস্য: আগেও পেটানো হয়েছিল বুধবারের নিহতকে, ছাড়া হয়েছিল ৩০ হাজার টাকায়

প্রতিবেশীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, এটাই প্রথম বার নয়। বছর পঞ্চান্নর যে ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তাঁকেই চোর সন্দেহে এর আগেও তুলে নিয়ে এসে মারধর করেছিলেন সুরজিতেরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৯ ০২:০৭
Share:

আদালতের পথে অভিযুক্ত তাপস সাহা। বৃহস্পতিবার। (ইনসেটে) রতন কর্মকার। নিজস্ব চিত্র

পাড়ার মোড়ে মোড়ে জটলা। মানিকতলার হরিশ নিয়োগী রোডে এক ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনায় অভিযুক্তদের নামগুলো বলতেই বৃহস্পতিবার তাঁদের বাড়ি তিনটি চিনিয়ে দিলেন প্রতিবেশীরা। দু’টি বাড়িতে তালা ঝুলছে। তিন নম্বর বাড়ির বাসিন্দা এক মহিলা বললেন, ‘‘আমিই সুরজিৎ কুন্ডুর মা। ফোনেও পাচ্ছি না ছেলেকে। কথা হলেই বলব, পুলিশে ধরা দে। পালিয়ে বেড়াস না।’’ এর পরে তাঁর দাবি, ‘‘আমার ছেলেটা খুব ভাল। দলে পড়ে এ রকম করে ফেলেছে।’’

Advertisement

প্রতিবেশীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, এটাই প্রথম বার নয়। বছর পঞ্চান্নর যে ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, তাঁকেই চোর সন্দেহে এর আগেও তুলে নিয়ে এসে মারধর করেছিলেন সুরজিতেরা। সেই সময়ে ৩০ হাজার টাকা নেওয়ার পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানাচ্ছেন এক আত্মীয়। তাঁর কথায়, ‘‘এ বারও হয়তো সুরজিতেরা টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তবে ভদ্রলোক যে মারা যেতে পারেন, তা ওরা বোঝেনি।’’ পাড়ার অন্য বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ‘‘চোর হলে তো পুলিশে তুলে দেওয়ার কথা। মারার অধিকার ওদের কে দিয়েছে?’’

বুধবার সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে মানিকতলার হরিশ নিয়োগী রোডের একটি ক্লাবঘরে রতন কর্মকার নামের ওই ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে হাত-পা বেঁধে ক্রিকেট ব্যাট ও উইকেট দিয়ে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। এর পরে পাড়ারই এক চিকিৎসককে ডেকে আনা হয়। তিনি মৃত ঘোষণা করার পরে রতনকে ক্লাবে বন্ধ করে রেখেই সরে পড়েন অভিযুক্তেরা। পরে পুলিশ গিয়ে ক্লাবঘরের দরজা ভেঙে মৃতদেহ উদ্ধার করে। রাতে তাপস সাহা নামে বছর সাতাশের এক স্থানীয় যুবককে গ্রেফতার করে মানিকতলা থানার পুলিশ। তাঁকে জেরা করেই সুরজিৎ এবং দীপ সরকারের নাম জানা যায়। রবি সাহা নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে মানিকতলা থানা। রবিবাবু এ দিন বলেন, ‘‘ক্লাবে এক জনকে বেঁধে পেটানো হচ্ছে দেখে আমরা বাধা দিতে যাই। উল্টে ওরা আমাদেরই ধমকে তাড়িয়ে দেয়।’’

Advertisement

পুলিশ জেনেছে, রতনবাবুর বাড়ি হুগলির আদি সপ্তগ্রামে। তিনি নিজের এলাকায় ‘চোরা রতন’ নামে পরিচিত ছিলেন। আগে চুরির অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল। তবে কিছু দিন ধরে তিনি সে সব ছেড়ে কাপড়ের ব্যবসা করছিলেন বলে প্রতিবেশীদের দাবি। রতনবাবুর দুই বিবাহিতা মেয়ে রয়েছেন। তাঁর ছোট মেয়ে অনামিকা দলুই এ দিন বলেন, ‘‘মাত্র ২০ দিন আগে মা মারা গিয়েছেন। তাই ক’দিন বাবার কাছে থাকছিলাম।’’ মেয়ের দাবি, বুধবার সকালে কলকাতায় যাচ্ছেন বলে বাড়ি থেকে বেরোন রতনবাবু। সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ বাবার সঙ্গে শেষ বার কথা হয় তাঁর। মেয়ের কথায়, ‘‘তখন ফোন ধরে বাবা বললেন, দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। এর পরে আমার এক বান্ধবীকে ফোন করে এক ব্যক্তি জানান, বাবার অটো-দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমার মোবাইলে আবার ফোন করে কেউ বলেন, ‘তোমার বাবা চুরি করে ধরা পড়েছে। এখনই এসো।’ তখনও বিশ্বাস করিনি। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ টিভিতে খবরে দেখি, বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে।’’ মেয়েরও প্রশ্ন, ‘‘চুরি যদি করেও থাকেন, পুলিশে জানায়নি কেন? কেন খুন করা হল?’’

এ দিন মানিকতলা থানায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিল রঞ্জিত সাহা নামে এক ব্যক্তিকে। তিনি জানান, খন্নার হাটে তাঁর তৈরি ‘লেগিংস’ বিক্রি করতেন সমীরণ দত্ত নামে এক যুবক। রঞ্জিতের দাবি, ‘‘সমীরণের কাছ থেকে ১৭ ডজন লেগিংস নেন রতন। দাম প্রায় ১৪ হাজার টাকা। সেই বস্তা রাস্তা পার করিয়ে দেওয়ার পরে আরও ১৫ ডজন লেগিংস চান রতন। তা নিয়ে ফিরে এসে সমীরণ দেখেন, টাকা না দিয়েই রতন চলে গিয়েছেন। এর পরে আমরা বড়তলা থানায় অভিযোগ করি। পরে তো শুনলাম এই ঘটনা।’’

কিন্তু রতনবাবু যদি সত্যিই লেগিংস চুরি করে থাকেন, তা উদ্ধার হল না কেন? মারধরে অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁর দেখাই বা হল কোথায়? এই সমস্ত প্রশ্নের ধোঁয়াশা কাটেনি বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত। ধৃত তাপসকে এ দিন শিয়ালদহ আদালতে তোলা হলে সরকারি আইনজীবী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই ঘটনায় অনেক রহস্য রয়েছে। অভিযুক্তেরা সকলে ধরাও পড়েনি।’’ সওয়াল-জবাব শুনে তাপসকে ২০ জুন পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন