ছ’দশক পরেও উৎসবের শহরে সুরের ফেরিওয়ালা ওঁরা

স্বাধীনতার আগে-পরে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন কিছু যুবক। বাঙালির কাছে তাঁদের ব্যান্ড জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি। দেখাদেখি একের পর এক দোকান তৈরি হতে থাকে মহাত্মা গাঁধী রোডের ধারে।

Advertisement

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০২:২৩
Share:

বাজনদার: ট্রাম্পেট সানাই নিয়ে রাজপথে।

দুপুর বা বিকেলে গাড়ির চাপে থমকে যাওয়া মহাত্মা গাঁধী রোডের ধারে দেখা মেলে ওঁদের। কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মোড় পর্যন্ত অংশে। ধূসর ফুটপাথে উজ্জ্বল রঙের ঝলক এনে তখন চলে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। ওঁরা ব্রাস ব্যান্ডের সদস্য। চলতি কথায় যাঁদের বলা হয় ব্যান্ড পার্টি। শহরের পুজো হোক বা বিয়েবাড়ি— সুর মেলাতে সবার আগে ডাক পড়ত তাঁদেরই। ডিজে-র যুগে আকর্ষণ ফিকে হয়েছে বেশ খানিকটা। তবে তিন-চার পুরুষের পেশা ছাড়েননি তাঁদের বেশির ভাগই।

Advertisement

স্বাধীনতার আগে-পরে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন কিছু যুবক। বাঙালির কাছে তাঁদের ব্যান্ড জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি। দেখাদেখি একের পর এক দোকান তৈরি হতে থাকে মহাত্মা গাঁধী রোডের ধারে। এখনও ব্যান্ডের অধিকাংশ বাজিয়ে আসেন বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকেই। কেউ কেউ আবার থাকেন হাওড়া বা শহরতলিতে। বাবা-কাকাকে দেখে এক সময়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন ট্রাম্পেট, ক্ল্যারিনেট, স্যাক্সোফোন, সানাই, ড্রাম বা ঝুনঝুনি। তাঁদের কাছেই চলেছে তালিম।

নভেম্বর থেকে মার্চ এই বাজিয়েদের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ওই সময়টা বিয়ের মরশুম। তার আগে শহরে হাজির হন তাঁরা। বড়বাজারের এক চিলতে ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকেন ক’টা মাস। একসঙ্গে বসে ব্যান্ড মাস্টারের নির্দেশ অনুযায়ী চলে রিহার্সাল, গান বাছাই। অনুষ্ঠানের বরাত অনুযায়ী দোকান থেকে ফোনে ডাক পৌঁছয় তাঁদের কাছে। ফিকে হতে থাকা ইউনিফর্মে নিজেদের সাজিয়ে ঘষে-মেজে নেন প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটিকে। তার পর পায়ে পায়ে সুর মেলানোর পালা। মরশুম ফুরোলে বাজিয়েরা ফিরে যান নিজের নিজের গাঁয়ে। বাজনা ছেড়ে মন দেন চাষবাস বা ব্যবসায়।

Advertisement

কখনও একটু জিরিয়ে নেওয়া।

বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যান্ডের মহম্মদ নইম জানালেন, শুধু বাজনা নয়, ব্যান্ড পার্টির শোভাযাত্রায় থাকে সুসজ্জিত গেট, পেট্রোম্যাক্স বা বাহারি এলইডি আলো। শুধু সানাইয়ের সুর চাইলে ৩ জনেই কাজ চলে। পুরো ব্যান্ড চাইলে প্রয়োজন অন্তত ১২ জন বাজিয়ের। রেস্ত বেশি হলে ১৬, ২০, ২৫, ৩১, ৪১ বা ৫১ পর্যন্ত সদস্য থাকতে পারেন ব্যান্ডে। দু’ঘণ্টা করে শিফ্‌টের হিসেবে চুক্তি হয়ে থাকে। যাঁরা
ব্যান্ডের বরাত দিচ্ছেন, তাঁরা চাইলে মাথার গোলাপি পাগড়ি কি ঘোড়ায় টানা গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিতে পারে ব্যান্ড পার্টিই।

ব্যবসায় প্রতিদ্বন্দ্বী হলে কী হবে, ডিজে বক্সের কথা শুনলেই এককাট্টা মহম্মদ নাদিম, শাকিল ভাই, মহম্মদ নইমেরা। তাঁদের বক্তব্য, ডিজে বক্স বাজানো তো নিষিদ্ধ। জোর করে বাজানো হয়। শাকিল ভাই বলেন, ‘‘লাইভ মিউজিক-এর ব্যাপারটাই আলাদা। ব্যান্ডের বাজনা শুরু হলেই যে কোনও অনুষ্ঠান জমে যায়।। ‘মুড’ বুঝে পছন্দের সুর বাজানো, ভিড়কে মাতিয়ে রাখায় কিন্তু এখনও আমাদের জুড়ি পাওয়া মুশকিল।’’

মেহবুব ব্যান্ডের শওকত আলি জানাচ্ছেন, রাস্তায় শোভাযাত্রা করে যাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়াই ব্যান্ডের ব্যবসা কমার অন্যতম কারণ । বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জারি হওয়া এই নিষেধাজ্ঞার জেরে পুলিশ তাঁদের নানা ভাবে হেনস্তা করে বলেও অভিযোগ তাঁর। ছ’দশকের চলার পথে তাঁদের দলে রয়েছেন তৃতীয় প্রজন্মের বাজিয়েরাও। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ওয়েবসাইটও খুলেছেন কেউ কেউ। তবে হাল না ফিরলে নতুন প্রজন্ম এ পথে হাঁটবে না— স্পষ্টই বলে দিলেন তিনি।

কলকাতা ব্যান্ডের শাকিল ভাই অবশ্য বলেন, ‘‘আমরা আছি। সহজে হাল ছাড়ব না। আগে বড় পুজোর বিসর্জনে আমাদের ডাক পড়তই। এখন সেটা কমলেও ডাক আসছে আইপিএল-পার্টি বা কলেজ রিইউনিয়ন থেকে।’’

অজস্র উদ্‌যাপনের সাক্ষী থাকা এই সুরের ফেরিওয়ালাদের আশা, উৎসবের শহর তাঁদের মনে রাখবে।

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন