এন আর এস

ডেঙ্গিতে কাবু হস্টেল, প্রশ্নের মুখে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা

ডেঙ্গিতে কাঁপছেন ডাক্তারেরা! তাঁরা রোগীর সেবা করবেন কী, উল্টে তাঁদেরই সেবার প্রয়োজন হচ্ছে। কলকাতার অন্যতম নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীলরতনের (এনআরএস) দুই প্রধান ছাত্র হোস্টেলে ডেঙ্গি এমন তাণ্ডব শুরু করেছে যে, একের পর এক জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:২৭
Share:

হাসপাতাল চত্বরে খোলা নর্দমা। — নিজস্ব চিত্র

ডেঙ্গিতে কাঁপছেন ডাক্তারেরা! তাঁরা রোগীর সেবা করবেন কী, উল্টে তাঁদেরই সেবার প্রয়োজন হচ্ছে।

Advertisement

কলকাতার অন্যতম নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীলরতনের (এনআরএস) দুই প্রধান ছাত্র হোস্টেলে ডেঙ্গি এমন তাণ্ডব শুরু করেছে যে, একের পর এক জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার চাপটা থাকে মূলত এঁদের কাঁধেই। ফলে রোগীদের দেখভাল করবেন কারা, তা নিয়েই সমস্যায় পড়েছেন কর্তৃপক্ষ।

অথচ আক্রান্তরা সকলে স্বাস্থ্য দফতরেরই কর্মী, যে দফতর ক্রমাগত দাবি করে যাচ্ছে, ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। শুধু তা-ই নয়, এনআরএস হাসপাতাল যে পুর-এলাকার আওতায়, তাঁরা সমানেই দাবি করে এসেছেন— মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজে তাঁদের কোনও ত্রুটি নেই, ডেঙ্গি-পরিস্থিতিও স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে এ যেন খানিকটা বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার হাল!

Advertisement

চলতি মরসুমে নীলরতনে ডেঙ্গি পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছিল অগস্ট মাস থেকেই। গত পনেরো দিনে তা চরমে উঠেছে। এই সময়ে হস্টেলের বাসিন্দা পুরুষ-মহিলা জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়া মিলিয়ে কম করে ২৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবারই স্ত্রীরোগ বিভাগের তিন জন পিজিটি-র রক্তে ডেঙ্গির ভাইরাস মিলেছে। আতঙ্কে হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেক পড়ুয়া। পুজোর সময়ে অনুজা ভারতী নামে এক ইন্টার্নের ডেঙ্গিতে এতটাই অবস্থা খারাপ ছিল যে, তাঁকে বেশ কিছু দিন সিসিইউ-য়ে রাখতে হয়। শৌনক ব্যাপারী নামে মেডিসিন বিভাগের এক হাউজস্টাফের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দু’দিন আগেই এসএসকেএম স্থানান্তরিত করে তাঁর ডায়ালিসিস শুরু করা হয়েছে।

এ বছর অক্টোবর শেষ হতে চললেও ডেঙ্গির দাপট কমার নাম নেই। এর জন্য যেমন আঙুল উঠছে আবহাওয়ার পরিবর্তনের দিকে, তেমনই মশা নিয়ন্ত্রণে পুরসভাগুলির ব্যর্থতা ও ডেঙ্গি সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য চেপে রাখতে স্বাস্থ্য দফতরের আপ্রাণ চেষ্টাকেও বিভিন্ন মহল থেকে দায়ী করা হয়েছে। কারণ, প্রকৃত তথ্য না পেলে যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব নয়। যা পরিসংখ্যান সামনে এসেছে, তার ভিত্তিতেই এ বছর ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।

নবান্ন সূত্রের খবর, বুধবার স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে-র ডাকা ডেঙ্গি সংক্রান্ত বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে। স্বাস্থ্য দফতর এত দিন দাবি করছিল, রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্ত সাড়ে আট হাজারের মতো, আর মৃতের সংখ্যা ৩২। তারাই বৈঠকে কার্যত ঢোঁক গিলে স্বীকার করেছে, আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গি এখনও নিশ্চিত হয়নি, এমন জ্বরে ভুগছেন আরও ৬ হাজার। ডেঙ্গিতে এখনও পর্যন্ত মৃত ৪০। যদিও এই তথ্য তারা দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রকে এখনও জানায়নি। সেখানে এ রাজ্য থেকে শেষ তথ্য গিয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর।

মশা ও লার্ভা মারার তেল ও ধোঁয়ার মানের প্রসঙ্গও ওঠে বুধবারের বৈঠকে। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষের দাবি, তাঁরা দিল্লির পতঙ্গবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ থেকেই তেল আনেন। পাশাপাশি, মশা নিয়ন্ত্রণের তাঁদের কোনও খামতি নেই বলেও দাবি করেছেন মেয়র পারিষদ।

তা হলে নীলরতন চত্বরে দুই হস্টেলে এ ভাবে ডেঙ্গি ছড়াল কী করে? অতীনবাবুর উত্তর, ‘‘নীলরতনে জুনিয়র ডাক্তার ও পড়ুয়ারা এই হারে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে আমার কাছে এখনও খবর নেই। তবে নীলরতনে দু’বার অভিযানে গিয়েছি। মশা নিয়ন্ত্রণে সেখানে কী করা উচিত, তা-ও কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে এসেছি। হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার রাখাটা ওদের দায়িত্ব।’’ কলকাতায় ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত কলকাতায় আক্রান্ত ৯০০-র কিছু বেশি। মারা গিয়েছেন ৩ জন। কিন্তু এঁদের মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি কি না, তা স্বাস্থ্য দফতর নিশ্চিত বলেনি। কলকাতায় রোজ বাইরে থেকে ৫০-৬০ লক্ষ মানুষ আসেন। তাঁরা কে কোন ভাইরাস বহন করে আনেন, কেউ জানে না। সেখান থেকেই রোগ ছড়ায়। তা ছাড়া, মানুষের সচেতনতার অভাবও এর জন্য দায়ী।’’

নীলরতনে মর্গের পাশে ছেলেদের মেন হস্টেলে প্রায় ৬০০ আবাসিক থাকেন। এ বছর এখনও পর্যন্ত এঁদের মধ্যে প্রায় ১০০ জনের ডেঙ্গি হয়েছে। গত ১৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ জন। হস্টেলে থাকাকালীনই সম্প্রতি ডেঙ্গি ধরা পড়ে এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র নীলাঞ্জন দত্তের। রোগের জটিলতা এত বাড়ে যে, প্লেটলেট কাউন্ট কমে হয় ৬০ হাজার। যকৃতও বেড়ে যায়। নীলাঞ্জনের কথায়, ‘‘হস্টেলে ঝাড়ুদার আসে না। দিনের পর দিন জঞ্জাল সাফ হয় না, জল পরিষ্কার হয় না। হাসপাতাল চত্বরে অনেক নির্মাণকাজ চলছে, সেখানেও জল জমে থাকে। কর্তৃপক্ষকে বহু বার বলা হয়েছে। বলার পরে ক’দিন ঠিক থাকে, আবার যে-কে-সেই।’’

নীলরতন চত্বরেই মেয়েদের লেডি এলিয়ট হস্টেলের বাসিন্দা ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী অনন্যা কিস্কু। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বন্ধু পুজোর আগে থেকে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। ওরা হস্টেলে থাকে। পুজোর আগে এ নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে হস্টেলে মশা মারার ধোঁয়া দেওয়া হয়। কিন্তু চারপাশ যদি সাফ না হয়, তা হলে কোনও লাভ হবে না।’’

এ ব্যাপারে নীলরতনের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘হস্টেলে অনেকেরই ডেঙ্গি হচ্ছে। যা ব্যবস্থা নেওয়ার, আমরা নিচ্ছি।’’

এনআরএস পুরসভার ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে। কাউন্সিলর অরুণ দাসের বক্তব্য, ‘‘জানি এনআরএসে খুব ডেঙ্গি হচ্ছে। মূলত জুনিয়র ডাক্তারেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ঝাড়ুদার হাসপাতাল চত্বর সাফ না করলে এটাই হবে। আমাদের লোক সীমিত, এলাকা বিশাল, প্রচুর বস্তিও রয়েছে। তাই ঝাড়ুদারদের সেখানে পাঠাতে হয়। লোকবল কম।’’ অরুণবাবু জানান, মাঝেমধ্যেই তাঁরা নীলরতনে মশা মারার স্প্রে, ধোঁয়া দেন। কিন্তু ‘‘ডেঙ্গির মশা এখন সহজে কাবু হয় না,’’ মত তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন