সিমলা পাড়া

খেলাধুলোর চর্চাটা বেশ কমে গিয়েছে

আমার জন্ম ১৯৪৭ সালে। তখন থেকেই আমি রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের এই বাড়িতে। কর্মসূত্রে ভিন্‌ রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ এলেও যাইনি। ফলে, এই পাড়ার সঙ্গে আমার প্রাণের যোগ। সিমলা পাড়ায় বহু বিখ্যাত মানুষ থেকেছেন।

Advertisement

পরিমল চন্দ্র

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৫ ০০:২০
Share:

আমার জন্ম ১৯৪৭ সালে। তখন থেকেই আমি রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের এই বাড়িতে। কর্মসূত্রে ভিন্‌ রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ এলেও যাইনি। ফলে, এই পাড়ার সঙ্গে আমার প্রাণের যোগ। সিমলা পাড়ায় বহু বিখ্যাত মানুষ থেকেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম প্রেসিডেন্ট উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে ও মান্না দে, অভিনেত্রী ছায়া দেবী, বাঁশিবাদক গৌর গোস্বামী— এ পাড়ারই বাসিন্দা ছিলেন। এঁদের স্মৃতি শুধুই পুরনো বাসিন্দাদের মনে টিকে আছে। বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি ছাড়া অন্য কারও বাড়ি সংরক্ষণ হয়নি। অন্তত উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটা সংরক্ষণ করা উচিত। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটির অবস্থা খুবই খারাপ।

Advertisement

আমাদের পাড়া থেকে উত্তর কলকাতার সাবেক ছোঁয়া একেবারে মুছে যায়নি। রাস্তায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের আন্তরিকতা টিকে আছে এখনও। কারও বিপদে খবরটুকু পেলেই অনেকে পৌঁছে যান সাহায্য করতে। এই পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশই এই পাড়ার পরিচয়। এ পাড়ার পুরনো অনেক বাড়ি এখনও অক্ষত। কিছু বাড়ি ভাঙা হলেও খুব উঁচু আবাসন এখনও হয়নি। পুরনো বাড়িগুলো একদম পাশাপাশি হওয়ার কারণেই বোধহয় উঁচু বাড়ি তৈরি সম্ভব হয় না। ফলে পাড়ার চেহারাটা বিশেষ বদলায়নি। তবে কিছু পুরনো বাড়ি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। মাসখানেক আগে ছাতুবাবুর বাজারের কাছে একটি বাড়ির কিছু অংশ ভেঙে রাস্তায় পড়েছিল। সকালে হওয়ায় কেউ আহত হননি। বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত পুরসভার। নতুন বাড়িগুলোয় বাঙালি ছাড়া অন্য প্রদেশের মানুষেরা সম্প্রতি বসবাস করছেন। এতে পাড়ার পরিবেশও কিছুটা বদলেছে।

এখন সবাই ব্যস্ত। বাড়ির রকে বিশুদ্ধ আড্ডা দিতে আর কাউকে বিশেষ দেখি না। তাসের আড্ডা হয় কোথাও কোথাও। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কোনও কোনও ব্যক্তির বাড়ির সামনে দলীয় কর্মীদের একটা জটলা সব সময়েই দেখা যায়। নকশাল আমল বাদ দিলে আমাদের পাড়ায় রাজনৈতিক কারণে গোলমাল হয়নি কখনও। রাজনৈতিক মতভেদের ছায়া ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরে পড়ে না।

Advertisement

আগে পাড়ায় খেলাধুলোর চর্চা ছিল অনেক বেশি। আমার বড়দা, সাঁতারু বিমল চন্দ্র অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমসে যোগ দিয়েছিলেন, ইংলিশ চ্যানেলও পার করেছিলেন। তাঁকে দেখেই সাঁতারে আসা। অন্য দুই দাদাও সাঁতারু ছিলেন। ১৯৬৩ আর ১৯৬৪ সালে আমরা চার ভাই এক সঙ্গে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলাম। হেদুয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতাম। এখন মন দিয়ে সাঁতারের চর্চা অনেক কমে গিয়েছে। অভিভাবকেরাও চান ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় বেশি মন দিক। ফলে অনুশীলনের সময়ও পায় না। পাড়ায় কিছু ফুটবল-ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয়। তবে তা বিনোদনমূলক। সিমলা ব্যায়াম সমিতির মতো সংস্থার কর্মসূচীও খুব সীমিত হয়ে গিয়েছে।

এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় পুজো হয়। সারা দিন-রাত বহু মানুষ আসেন ঠাকুর দেখতে। পাড়ার সব রাস্তাই ভিড়ে গমগম করে। ভিড়ের জন্য অসুবিধা হলেও পুজোর আনন্দের খাতিরে ওইটুকু মেনে নিই। পাড়ায় মাইক বাজিয়ে কোনও অনুষ্ঠান হলেও রাত দশটার পর সাধারণত তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পাড়ার ছেলেদের বলতেও হয় না। আগের থেকে এ বিষয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। গিরিশ পার্ক থানা কাছেই হওয়ায় রাতে পাড়ার মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও বিশেষ ঘটে না। এখন তো শহর থেকে রথ-চড়কের মেলা উঠে গিয়েছে, অথবা ছোট করে হয়। কিন্তু ছাতুবাবুর বাজারে চড়কের মেলা এখনও হয় খুব বড় করে। চড়কের গাছ বাঁধা হয়, অনেক সাধু আসেন, দর্শকের ভিড়ও হয়। তবে কাঁটা-বঁটির উপরে ঝাঁপ দেওয়ার মতো বিপজ্জনক খেলাগুলো প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে।

এ পাড়া মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয়। তবে পুরসভার সাফাইকর্মীরা মাঝেমধ্যেই এর জন্য বেশি টাকা দাবি করেন। আগে বাসিন্দারা নিজের ইচ্ছেমতো বকশিশ দিতেন, সেটাই এখন ওঁদের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিছু বাসিন্দা প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরে রাস্তায় ফেলেন, অনেক সময়ে তা পথচারীদের গায়েও পড়ে। পাড়া সাফসুতরো রাখতে নিজেদেরই সচেতনতা দরকার। ভোরে জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া যে কেন তুলে দেওয়া হল, জানি না। জলের তো অভাব নেই। অনেক কল দিয়ে গঙ্গার জল সারাদিন পড়ে। এমনকী কিছু কল দিয়ে পানীয় জলেরও অপচয় হয় প্রচুর। ওই কলগুলি প্রয়োজনমতো বন্ধ-খোলার ব্যবস্থা করা উচিত। ছাতুবাবুর বাজারে এখনও অনেক জায়গায় ত্রিপলের ছাউনিই ভরসা। বর্ষায় ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেরই অসুবিধা হয় এতে। সব জায়গায় ছাদ করলে ভাল হয়। আগে ডব্লিউ সি ব্যানার্জি স্ট্রিটে খুব জল জমত। এখনও সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে, কিন্তু পাম্পের সাহায্যে তা দ্রুত বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে দু’-এক বছর আগে। রাস্তায় কোনও কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি হলে কয়েক দিন পরেই তা সারিয়ে ফেলা হয়।

এলাকার কয়েকটি ভাল স্কুল-কলেজ যেমন বেথুন, স্কটিশ চার্চ, সেন্ট মার্গারেট স্কুল। কেশব অ্যাকাডেমির মতো স্কুলেও ইদানীং পড়ুয়ার অভাব। সবাই ইংরেজি মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন। এলাকায় স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন পালন হয় দু’-তিন দিন ধরে। বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা আসেন। বিরাট শোভাযাত্রা বেরোয়।

ভাল-মন্দের বিচারে আমাদের পাড়ায় ভালরই পাল্লা ভারী। প্রায় ৬৮ বছর এখানে কাটিয়ে অন্য কোথাও থাকার কথা ভাবতেও পারি না।

লেখক বিশিষ্ট সাঁতারু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন