বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার খরচ কমানো নিয়ে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির প্রস্তাবে কার্যত না করে দিল কলকাতার বিভিন্ন স্কুল।
শুধু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নির্দেশ খারিজ করাই নয়, ‘এই বিষয়ে মন্ত্রীর নাক গলানো উচিত নয়’ বলেও মন্তব্য করলেন শহরের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা।
কয়েক দিন আগেই দিল্লিতে স্মৃতি ইরানি জানান, দেশের সমস্ত বেসরকারি স্কুলগুলি শিক্ষাবর্ষের মাঝেই ইচ্ছামতো পড়াশোনার খরচ বৃদ্ধি করতে পারবে না। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বেতন বৃদ্ধি করতে হলেও আলোচনা করতে হবে শিক্ষক ও অভিভাবক সংগঠনের সঙ্গে। এর পরেই শুরু হয় বিতর্ক। শহরের প্রধান বেসরকারি স্কুলগুলির যুক্তি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই পড়াশুনার ফি-এর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট স্কুলের উপরে নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই কারও হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। যদিও স্মৃতি ইরানি তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে পেয়ে গিয়েছেন অভিভাবকদের একটি বড় অংশ এবং শিক্ষক সংগঠনকে।
কলকাতা শহরে সিবিএসই এবং আইসিএসই স্কুলগুলিতে পড়াশোনার খরচ যে ক্রমশ মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে তা নিয়ে অভিভাবকদের অধিকাংশই একমত। অভিযোগ, অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই প্রতি বছর আট থেকে দশ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি করা হয়। যত উঁচু শ্রেণিতে পৌঁছনো যায়, ততই বাড়তে থাকে খরচের বোঝা। পরীক্ষা ফি, উন্নয়ন ফি-সহ একাধিক ফি-এর বোঝা এসে পড়ে অভিভাবকদের উপরে। শহরের বহু ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে সন্তানদের পড়াতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা কার্যত হোঁচট খেয়ে পড়েন। সেখানে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে খরচ ঠিক করলে ভাল হয় বলে মন্তব্য অভিভাবকদের একাংশের। এক অভিভাবক বললেন, ‘‘সব থেকে অসুবিধা এক একটি স্কুলে এক এক রকম পড়াশুনার খরচ। ফলে ইচ্ছা থাকলেও, প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলেও ভাল স্কুলে ভর্তি করা যায় না। যে কারণে বরাবরই শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি হয়ে যাচ্ছে।’’
বেশ কিছু স্কুলের লাগামছাড়া ফি বৃদ্ধিতে নাজেহাল অভিভাবকেরা। মহাদেবী বিড়লা স্কুলের এক পড়ুয়ার অভিভাবক জানান, বছরের শুরুতেই প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ডোনেশন নেওয়া হয়। তৃতীয় শ্রেণিতেই ভর্তির খরচ ৩৭ হাজার টাকা। তবে এতটা বেশি খরচ নয় অন্য স্কুলগুলিতে। ক্লাসভিত্তিক বছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা নেওয়া হয় অনেক স্কুলেই। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘আমরা জানি এই টাকা দিতে আমরা বাধ্য। আমাদের মতামত নিয়ে তো আর ফি বাড়ানো হয় না। স্রেফ জানিয়ে দেওয়া হয়।’’
আইসিএসই বোর্ডের এগজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য তথা বরাহনগরের সেন্ট্রাল মর্ডান স্কুলের অধ্যক্ষ নবারুণ দে বলেন, ‘‘পড়াশুনার খরচ ঠিক করতে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়।’’ তা হলে তাঁরা কী করেন? নবারুণবাবু বলেন, ‘‘শিক্ষাবর্ষের শুরুতে স্কুলের তরফে নোটিস দিয়ে বর্ধিত খরচের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।’’ কেন অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ফি বৃদ্ধি করেন না তাঁরা? ওই স্কুলকর্তার মন্তব্য, ‘‘বেসরকারি স্কুলগুলি নিজেদের পরিকাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফি ধার্য করবে— এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অন্য কারও হস্তক্ষেপ না করাই ভাল।’’
সেন্ট জেমস স্কুলের অধ্যক্ষ টেরেন্স হ্যামিলটন আয়ারল্যান্ড বলেন, ‘‘মন্ত্রী যাই বলুন, গোটা বিষয়টা আমাদেরই সামলাতে হয়। অভিভাবক এবং পড়ুয়াদের কথা ভেবেই সব ঠিক করা হয়। পরিকাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাই সেটা ঠিক করব।’’ গোখেল মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ইন্দ্রাণী মিত্র বলেন, ‘‘শিক্ষাবর্ষের মাঝে কোনও ভাবেই খরচ বৃদ্ধি করা হয় না। বছরের শুরুতে বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু যে বোর্ড মিটিংয়ে তা ঠিক হয় সেখানে অভিভাবকদের প্রতিনিধি থাকেন। আলাদা করে অভিভাবকদের সংগঠনের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয় না।’’
কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তরফে তাঁরা এরকম কোনও প্রস্তাব পাননি। তাই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। মহাদেবী বিড়লা স্কুলের অধ্যক্ষা অঞ্জনা সাহা জানান, বার্ষিক সাধারণ সভায় অভিভাবকদের প্রতিনিধিদের সামনেই প্রস্তাবিত ফি চূড়ান্ত করা হয়। অঞ্জনাদেবী বলেন, ‘‘প্রতি বছর যে ফি বাড়ে তা নয়, প্রায় দু’বছর পর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে এ বার। তাও শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই।’’
তবে স্মৃতি ইরানির প্রস্তাবের আগে থেকেই যে এপিজে স্কুল সেই পথে হাঁটছে তেমনটাই জানালেন স্কুলের অধ্যক্ষ রীতা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছরই শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শ্রেণিভিত্তিক অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। সেখানে খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।’’