হেলমেটহীন বেপরোয়া ছুট। শনিবার রাতে, পার্ক স্ট্রিটে। — সুমন বল্লভ
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোতে তখনও মিনিট পনেরো বাকি। ময়দানের দিক থেকে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকল মোটরবাইকের দল। মাথায় হেলমেট নেই, কয়েকটি মোটরবাইকে তিন জন সওয়ারি। পুলিশের সামনে দিয়েই হইহই করে ছুটে গেল মল্লিকবাজারের দিকে।
এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে রাতভর। কখনও শহরের বুক চিরে এ দিক-সে দিক ছুটে চলেছে মোটরবাইক তো কখনও কোথাও বা একই বাইকে হেলমেটহীন চার সওয়ারি।
এই সবের মধ্যেই বদলে গেল বছর, কিন্তু বদলাল না মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য। শনিবার বর্ষশেষের রাতের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনটাই বলছে। আর সেই বর্ষবরণের উদযাপনে যথারীতি রাতভর টক্কর চলল পুলিশ ও মোটরবাইক আরোহীদের।
পার্ক স্ট্রিটে স্টিফেন হাউসের সামনে পুলিশি ধরপাকড় চলেছে। কিন্তু সেটুকুই! বাকি শহরে মোটরবাইক ছিল কার্যত লাগামছাড়া মেজাজে। ফলে এত দিন ধরে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রচারে আদৌ কতটা লাভ হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। যদিও রাতভর বাইক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পরে এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘প্রচার তো চলেই। কিন্তু মানুষ নিজের ভাল না বুঝলে কী করা যাবে?’’
বর্ষবরণের উৎসবে ভিড় আছড়ে পড়ে মূলত পার্ক স্ট্রিটেই। শহরের কিছু অভিজাত ক্লাব, নাইটক্লাবে ভিড় জমলেও তার মেজাজ বিশৃঙ্খল হয় না। ফলে পার্ক স্ট্রিটের ভিড় নিয়েই বেশি মাথাব্যথা থাকে পুলিশের। শনিবার রাতেও শুধু পার্ক স্ট্রিটেই পুলিশের ৯০০ জন কর্মী-অফিসার মোতায়েন ছিলেন। মাঝরাস্তায় নামতে না দিয়ে ভিড়কে গার্ডরেলের মধ্যে দিয়ে লাইন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভিড়ে মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তা নিয়েও সক্রিয় ছিল লালবাজার। একটু বেচাল চোখে পড়লেই চটজলদি পাকড়াও করা হয়েছে মত্ত যুবকদের। নিরাপত্তায় মোড়া ছিল ময়দান থেকে শুরু করে ট্যাংরার চিনেপাড়া, ভবানীপুরের মতো আবাসিক চত্বরও। বহু রাস্তাতেই পিকেট করে নজরদারি চালাচ্ছিলেন পুলিশকর্মীরা। তবু দামাল মোটরবাইককে সামলানো গেল কই? তাদের দাপটে থতমত খেয়ে যাচ্ছিলেন অভিজ্ঞ পুলিশকর্তারাও।
পুলিশ জানায়, রাত সওয়া বারোটা নাগাদ একটি স্কুটিতে চেপে হেলমেটহীন তিন তরুণ চলেছিলেন মল্লিকবাজারের দিকে। এক পুলিশকর্মী পাকড়াও করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই জানা গেল, গাড়ির কোনও কাগজপত্র নেই। জরিমানা হবে শুনে এক তরুণের উত্তর, ‘‘পকেটে টাকাও নেই।’’ ভেসে এল এক কনস্টেবলের গলা। ‘‘স্যার দেখুন, মোটরবাইকে চার জন চেপেছে। অথচ না আছে লাইসেন্স, না আছে গাড়ির কাগজ।’’ এর মধ্যেই পাশ দিয়ে সোঁ করে বেরিয়ে গেল চারটি মোটরবাইকের কনভয়! সব ক’টিতেই হেলমেটহীন তিন জন করে সওয়ারি। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে তৎপর হলেন পদস্থকর্তারা। অতিরিক্ত বাহিনী এনে শুরু হল ধরপাকড়।
পার্ক স্ট্রিটে না হয় ধরপাকড় হয়েছে, কিন্তু শহরের অন্য রাস্তায়? তেমন তৎপরতা চোখে প়ড়েনি বলেই মত শহরবাসীর। বরং বেশ কিছু উড়ালপুল দিয়ে সুযোগ বুঝে অনেকেই মোটরবাইক ছুটিয়েছেন তেজে। আইনের ফাঁক গলতে পিছনে বসিয়েছেন বান্ধবীদেরও। অনেকেই বলছেন, পুজোর সময়ে যে ভাবে মোটরবাইক দমন অভিযানে নামে পুলিশ, বড়দিন বা বর্ষশেষে কিন্তু তেমন মেজাজ মেলেনি। কলকাতার ডিসি (ট্র্যাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমারের বক্তব্য, ‘‘পুজোর মতো অত মোটরবাইক রাস্তায় নামেনি। তা সত্ত্বেও হেলমেট না থাকলে জরিমানা করা হচ্ছে। লাইসেন্স, কাগজপত্র না থাকলে গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’’ তবে পুলিশের একাংশই বলছে, পার্ক স্ট্রিটে গাড়ি, ভিড় এবং মোটরবাইকের চাপ বেশি থাকায় অনেক সময়ে ধরপাকড়ে সমস্যাও হয়েছে। ‘‘এই ভিড়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ধরতে গেলে মোটরবাইকআরোহীরা বিপদ ঘটাতেন। তাতে সমস্যা আরও বাড়ত।’’ আর শহরের অন্য রাস্তা? ই এম বাইপাসের লাগোয়া রেস্তোরাঁ, পানশালা পাড়াগুলি? লালবাজার সূত্রের জবাব, সেখানেও নজরদারি ছিল। প্রয়োজনে ধরপাকড়ও হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, বর্ষশেষের রাতে গোটা শহরে বিশৃঙ্খলার জন্য ধরা হয়েছে ৩৭৪ জনকে। বেপরোয়া বাইক এবং মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ধরা পড়েছেন ৭৪৪ জন, আটক করা হয়েছে ৭টি গাড়িও।
এত দামালপনার পরেও অবশ্য স্বস্তি পেয়েছে পুলিশ। ভোরে ডিউটি শেষ করে ট্র্যাফিকের এক অফিসার হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘‘বর্ষশেষের রাতে কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি, এটাই রক্ষে!’’