গত এক দশকে থিম যুদ্ধ অনেক দেখেছে শহর। এ বার বোধ হয় উপকরণের যুদ্ধ দেখার পালা!
থিমের বাহার থাক না থাক, উপকরণেই এ বার টেক্কা দিতে বাজারে নেমেছে একাধিক পুজো কমিটি। কারও অস্ত্র দেশ-বিদেশের শামুক-ঝিনুক। কারও বা মূর্তি সাজছে রাংতার বাহারে। এন্টালির একটি পুজো তো মণ্ডপ জুড়ে কয়েক হাজার আয়না লাগিয়ে ফেলেছে। হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিকে আবার থ্রি-ডি পেন্টিংয়ের জন্য এসেছেন বিদেশি শিল্পী। কেউ খরচ বাঁচাতে গত বছরের উপকরণই নতুন ভাবে তুলে ধরছেন এ বার। কেউ গত বছরের প্লাইউড এ বার ব্যবহার করছেন। কেউ বা গত বছরের মণ্ডপের খুঁটি দিয়েই এ বার নতুন শিল্প ধরে তুলবেন!
উপকরণে বাহার এনে কয়েক বছর তাক লাগিয়েছে সন্তোষপুর লেকপল্লি ক্লাব। কখনও লোহার কড়াইয়ে এচিং শিল্প, কোনও বার সনাতনী কাঠ-কাপড়ে জবাফুলের আদলে মণ্ডপ। পুজোকর্তারা বলছেন, এ বার মণ্ডপ সাজাতে প্রায় বিশ্ব ঢুঁড়ে ফেলেছেন তাঁরা। মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভারত থেকে এনেছেন নানা আকারের ঝিনুক, শঙ্খ। তা দিয়েই সাজবে মণ্ডপ। লেকপল্লির কর্তা সোমনাথ দাসের দাবি, এক ইঞ্চি থেকে চার ফুট ব্যাসার্ধের ঝিনুক দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে দর্শকদের।
দক্ষিণ কলকাতার ঘরের ছেলে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ বার উত্তরে নিয়ে এসেছে হাতিবাগানের শিকদারবাগান পুজো কমিটি। সেখানে মাশরুম ব্যবহার করেই নানা ধরনের ইনস্টলেশন গড়ে তুলছেন সুব্রত। মণ্ডপের সামনে থাকছে ব্যাঙের ছাতার আদলে বিরাট এক স্তম্ভ।
মণ্ডপে ঢুকলে আয়নার কারিকুরিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে এন্টালি পদ্মপুকুরের ২০ পল্লীর পুজোয়। শিল্পী রিন্টু দাসের পরিকল্পনায় মণ্ডপে ব্যবহৃত হচ্ছে কয়েক হাজার ছোট ছোট আয়না। ফুল ঘিরে থিম তৈরিতে গত কয়েক বছরে শহরের নানা পুজোয় হাত পাকিয়েছেন রিন্টু। এ বার এন্টালির পুজোয় তিনি তুলে এনেছেন শিউলি ফুলকে। মণ্ডপে ঢুকলে মনে হতে পারে, শিউলির বৃষ্টি ঝরছে সেখানে! সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সাউথ পল্লীমঙ্গলের পুজোতেই আবার রিন্টু মণ্ডপসজ্জার উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন পেরেক, শিশুদের দুধের বোতলের নিপল, এসি-র পাইপ।
আয়না ব্যবহার করেছে হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রিটও। শিল্পী পরিমল সেখানে বিরাট বিরাট আকারের ৮-১০ ফুটের লম্বা আয়না ব্যবহার করা হয়েছে। মণ্ডপসজ্জায় তালপাতা ও কাচের স্লাইডকেও ব্যবহার করেছেন শিল্পী। তালপাতাকে ব্যবহার করছে হাতিবাগান সর্বজনীনও। ওড়িশার লোকশিল্প তালপাতায় এচিং করে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে রামায়ণ। মণ্ডপ সজ্জায় তালপাতায় হরেক কিসিমের কারুকাজ ব্যবহার করেছেন শিল্পী সঞ্জীব সাহা। এই কাজ করার জন্য ওড়িশার নানা প্রান্ত থেকে কারিগরদেরও নিয়ে এসেছেন তিনি।
কাশী বোস লেনের পুজো কমিটি এ বার চমক আনছে প্রতিমায়। মূর্তি রং করতে সোনালি ও রুপোলি রঙের রাংতা ব্যবহার করছেন প্রতিমাশিল্পী সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়। চালচিত্রে অবশ্য রঙের ব্যবহার থাকছে। মূর্তি সাজাতে রাজস্থান থেকে এক দল শিল্পীও এনেছেন। শিল্পীর আশা, মূর্তির মধ্যে রাজপুতানার মিনেকারি কাজ ফুটে উঠবে। বাঙালির ঘরের মেয়ে ‘উমা’র রূপও মিলবে। মণ্ডপেও চমক দিচ্ছেন শিল্পী শিবশঙ্কর দাস। বৌদ্ধ, মুসলিম ঘরানার স্থাপত্যের সঙ্গে থাকবে সাবেক চাঁদোয়া। প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ বলের ভিতরে এলইডি আলো ভরে আলো-ছায়ার খেলা দেখাবেন তিনি।
আলো-ছায়ার খেলা দেখা যাবে হাতিবাগানের নবীনপল্লীতেও। সেখানে শিল্পী মহেন্দ্র পাল নিয়ে এসেছেন বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের লুপ্তপ্রায় লণ্ঠন শিল্পকে। নানা মাপের হাজার দশেক লণ্ঠন আনিয়েছেন তিনি। তা ছাড়াও মণ্ডপের মাঝে লোহার শিক ব্যবহার করে তৈরি করছেন নিজস্ব মাপের দু’টি লণ্ঠন। মূল মণ্ডপের ভিতরেও প্রতিমার সামনে একটি লণ্ঠন থাকবে। তার ভিতরে থাকবে একটি লণ্ঠন দিয়ে তৈরি বিরাট ঝাড়বাতিও।
শহরের পুজোয় এ বার থ্রি-ডি পেন্টিংয়ের চমক দেখাতে চায় হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক। তাই দুই বাঙালি শিল্পী দীপ্তেশ ঘোষ দস্তিদার ও শান্তনু মিত্রের পাশাপাশি সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্পী ট্রেসি লিস্টামকেও নিয়ে এসেছেন পুজোকর্তারা। মণ্ডপের মেঝে ও ছাদে থ্রি-ডি পেন্টিং ফুটিয়ে তুলতে প্লাইউড, ক্যানভাস তো রয়েইছে, থাকবে ভিনাইল ও লিথো পোস্টারও। বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিকের উদ্যোক্তারা বলছেন, থ্রি-ডি পেন্টিংয়ে তাক লাগাতেই উপকরণের এত বৈচিত্র এনেছেন তাঁরা।
তবে এ সবের মাঝে কেউ কেই আবার উপকরণে নতুনত্ব আনছেন নেহাতই বাজেট কমাতে। বিভিন্ন পুজোকমিটির কর্তারা বলছেন, সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুজোর বাজারে অর্থের জোগান কমেছে। টানাটানি পড়েছে স্পনসর নিয়ে। এই অবস্থা আঁচ করে দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাব গত বছরের প্লাইউড রেখে দিয়েছিল। সেটাই এ বার নতুন করে ব্যবহার করছেন তাদের শিল্পী। একই কায়দায় বেহালার একটি পুজো কমিটিও গত বছরের খুঁটি দিয়ে মণ্ডপের কাজে ব্যবহার করছে। কিন্তু কী কাজে সেগুলি ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্য বলতে নারাজ পুজোকর্তারা।
পুজো কর্তারা বলুন বা না-ই বলুন, ‘পুরনো চাল’ দিয়ে ভাত রান্না করে এ বছর অন্তত কয়েক লক্ষ টাকা বাঁচিয়ে নিয়েছে ওই কর্তারা।