Sound

শব্দ নিয়ম না মানার সংস্কৃতি  সেই চলছেই

অবশ্য অনেকেই মনে করছেন, এটাই এই রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক সভার ভবিতব্য।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ ০৭:০৬
Share:

ব্রিগেডের পথে তারস্বরে ডিজে বাজিয়ে নাচ। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

‘টুম্পা’ রয়েছে। জোট-রফা রয়েছে। রয়েছে সমর্থকদের উল্লাস। যা নেই, তা হল শব্দবিধি মেনে চলা। অথচ রবিবারের ব্রিগেড শব্দবিধি মানার ক্ষেত্রে ‘ব্যতিক্রমী’ হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা। কিন্তু তা না করে এই সভাও গতানুগতিক সেই ‘শব্দদূষণ’-এর জালে জড়িয়ে গেল বলে আক্ষেপ তাঁদের।

Advertisement

অবশ্য অনেকেই মনে করছেন, এটাই এই রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক সভার ভবিতব্য। যেখানে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ বা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশিকা উপেক্ষা করেই মাইক বাজানো হয়। যেখানে খোলা জায়গায় মাইক বাজালে ‘সাউন্ড লিমিটর বাধ্যতামূলক’ কথাটা শুধুমাত্র একটি কাগজের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ যদি এর পাশাপাশি আর একটি পরিসংখ্যান রাখা যায় তা হলে দেখা যাবে, শুধু শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এই রাজ্যে ১৩ জন মানুষ মারা গিয়েছেন। সেই ‘শব্দ শহিদ’-দের স্মৃতি-সম্মানে বিন্দুমাত্র কোনও প্রয়াস দেখা যায় না কোনও রাজনৈতিক দলের তরফেই।

এক পরিবেশবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে? এ রাজ্যে ভোট নিয়ে এত কথা হয়, কিন্তু সেই কথাগুলো বলার সময়ে কোনও রাজনৈতিক দলই শব্দবিধির অস্তিত্ব স্বীকার করে না।’’ এক মনোবিদ জানাচ্ছেন, আসলে জোরে বললেই ঠিক কথা বলা হয়, এটা একটা মানসিকতা। তাঁর কথায়,
‘‘বাড়িতেও দেখবেন, যিনি অভিভাবক তিনি চেঁচিয়ে কথা বলছেন। আসলে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের একটা মাধ্যম হল এই জোরে বলা। রাজনৈতিক দলগুলিও সে কারণে জোরে মাইক বাজিয়ে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করে।’’

Advertisement

আরও একটি বিষয় এখানে কাজ করছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তা হল, ক্ষমতায় আসার পরে যে কোনও দল, সে রাজ্যেরই হোক বা কেন্দ্রের, তারা শব্দবিধিকে পরোয়া করে না! ফলে খোলা জায়গায় কোনও সভার ক্ষেত্রে শব্দবিধি মানার মাপকাঠি (৬৫ ডেসিবেল) অগ্রাহ্য করেই মাইক বাজানো হয়। আবার বিরোধী দলগুলিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা যুক্তি দেয়, ‘‘ওরা শব্দবিধি না মানলেও পুলিশ-প্রশাসনের তরফে কিছু বলা হয় না। আর আমরা করলেই যত অভিযোগ?’’ ফলে শব্দ নিয়ে এই পারস্পরিক তরজায় নিয়ম ভাঙে শুধু। যার ফল ভুগতে হয় আমজনতাকে। এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথায়, ‘‘আসলে দিনের শেষে অন্য সমস্ত কিছুর মতো শব্দের ক্ষেত্রেও ওরা-আমরার লড়াই চলে আসে। তাই শব্দবিধি লঙ্ঘিত হয়।’’ পরিবেশবিদ মোহিত রায় বলছেন, ‘‘শব্দ সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা আমাদের সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে। ফলে সেখানে শব্দ-আইন কে মানবে?’’

অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয়, শব্দ-প্রাবল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য এই রাজ্যের সাউন্ড লিমিটর ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেয়। অন্য দিকে, এখানকার কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও অনুষ্ঠানে শব্দবিধি মানার বিন্দুমাত্র প্রয়াসও দেখা যায় না। শব্দদূষণ নিয়ে দীর্ঘ বছর কাজ করা পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’ জানাচ্ছে, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধা শুধু এই রাজ্যেই দেখা যায়! না হলে যেখানে জাতীয় পরিবেশ আদালত স্পষ্ট বলে দিয়েছে, সাউন্ড লিমিটর ছাড়া মাইক বাজানো যাবে না, সেখানে তা উপেক্ষা করার সাহস আসে কোথা থেকে? সংগঠনের এক কর্তার কথায়, ‘‘আসলে পুলিশ-প্রশাসনের তরফেই তো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় না! অবশ্য ক্ষমতাসীন দল যখন শব্দবিধি ভাঙে, সেটাকে যেমন প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তেমনই বিরোধী দলগুলির ক্ষেত্রেও একই কারণে চুপ করে থাকতে হয়।’’ সবুজ মঞ্চ-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘সব রাজনৈতিক দল যখন আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে, তখন তারা মুখে বলে শব্দবিধি মানব। কিন্তু কেউই সেটা পালন করে না। আসলে শব্দ-নিয়ম না মানাটাই এ রাজ্যে নিয়ম হয়ে গিয়েছে।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলিরই তো নিয়ম মানার কথা। অথচ তারাই নিয়ম ভাঙছে।’’

এ দিনের ব্রিগেডে শব্দবিধি মানার নিয়ম সম্পর্কে জানতে কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তাকে ফোন করা হলে তিনি ‘একটু পরে ফোন করুন’ বলে ফোন কেটে দেন। পরে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন