সুরক্ষা: রোদ থেকে বাঁচতে হাত-মুখ ঢেকে পথে। ধর্মতলায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
ভরদুপুরে রোদ্দুর মাথায় নিয়ে এস এন ব্যানার্জি রোড ধরে হাঁটছিলেন প্রৌঢ় মানুষটি। ওয়েলিংটনের কাছে ফুটপাতে গিয়ে আর পারলেন না। পায়ের পেশি ধরে রাস্তাতেই বসে পড়লেন। তখন দরদর করে ঘামছেন বালিগঞ্জের বাসিন্দা ওই প্রৌঢ় পঙ্কজ বারুই। বেশ কিছু ক্ষণ পরে ধীরে ধীরে ধাতস্থ হলেন তিনি।
হেদুয়ার বাসিন্দা, বছর পঁয়ত্রিশের সৌদীপ্ত হালদারকে চাকরির কারণে দিনভর মোটরবাইকে ঘুরতে হয়। কয়েক দিন ধরেই সৌদীপ্ত লক্ষ করছিলেন, সারা দিন একটা ক্লান্তি ঘিরে রেখেছে তাঁকে। সকালে শরীর দুর্বল লাগছে। পর্যাপ্ত ঘুমের পরেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব অল্পই। সকাল ১১টা নাগাদ মায়ের হাত ধরে হেঁটে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল বেলেঘাটার বাসিন্দা, পাঁচ বছরের সোহম সরকার। রোদ থেকে বাঁচতে মা-সন্তান কারও মাথায় কিছু ছিল না। পরদিন থেকে ক্লান্তি, বমি ভাব, পেটে ব্যথা শুরু হয় সোহমের।
শহরের তিন প্রান্তের এই তিনটি ঘটনার যোগসূত্র একটিই। তা হল সূর্যের তাপ। আর সেই তাপের হাত থেকে বাঁচতে ‘রক্ষাকবচ’ নিয়ে চলাফেরার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
অত্যধিক গরম এবং আর্দ্রতা প্রতি বছরই শরীরের পক্ষে সমস্যা তৈরি করে। তাপপ্রবাহের জেরে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে গোড়াতেই সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এখনও পর্যন্ত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ঘর টপকায়নি ঠিকই। তবুও রোদের তেজে তাপজনিত অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
কী সেই লক্ষণ?
চিকিৎসকদের মতে, তাপজনিত অসুখের তিনটি ধাপ। হিট ক্র্যাম্প, হিট এক্সশ্চান এবং হিট স্ট্রোক বা সান স্ট্রোক। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসক জ্যোতির্ময় পাল বলেন, ‘‘এ ধরনের অসুখের একেবারে প্রাথমিক লক্ষণ হিট ক্র্যাম্প। দুর্বলতা, অবসাদের পাশাপাশি পেশীতে মাঝেমধ্যেই টান ধরলে বুঝতে হবে রোগী হিট ক্র্যাম্পের শিকার। যদি শরীরের তাপ আরও বাড়ে, তা
হলে রোগী প্রচণ্ড ঘামবেন। একে বলা হয়, হিট এক্সশ্চান। চূড়ান্ত পর্যায় হল হিট স্ট্রোক। এ ক্ষেত্রে শরীরের তাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চামড়া শুকিয়ে যায়। ফলে শরীর থেকে ঘাম বেরোতে পারে না। যার জেরে রক্তের প্রবাহ কমে মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে। বিকল হতে পারে হৃৎপিণ্ড, লিভার এবং কিডনি।’’
শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস জানাচ্ছেন, সূর্যের তাপজনিত অসুখের দ্বিতীয় ধাপের লক্ষণ হল প্রচণ্ড ঘাম, জিভ শুকিয়ে যাওয়া। ঘামের সঙ্গে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড বেরিয়ে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। তাঁর কথায়, ‘‘ঘামলে শরীর ঠান্ডা হয়। হিট স্ট্রোকে সেটা হয় না বলেই যত বিপত্তি।’’
তবে অরিন্দমবাবুর মত, কলকাতার পথে-ঘাটে প্রথম দু’টি লক্ষণই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানান, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম, জল কম খাওয়া, রোদের মধ্যে হাঁটাচলার জেরে এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘‘শরীরে নুন ও জলের মাত্রা ঠিক রাখা খুব জরুরি। নিরুপায় না হলে টানা রোদে না থাকাই ভাল।’’ ডাক্তারদের আরও পরামর্শ, চড়া রোদে যদি বেরোতেই হয়, অবশ্যই সঙ্গে থাকা দরকার ছাতা বা রোদচশমা।
তাপজনিত অসুখ প্রসঙ্গে সতর্ক রাজ্য প্রশাসনও। রাজ্যের বিপর্যয় মোবাকিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, ‘‘এপ্রিলের শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাধারণত তাপপ্রবাহের সময় ধরে চলা হয়। ওই সময়ে রোদের মধ্যে যাতে মানুষ ঘর থেকে না বেরোন, সে বিষয়ে প্রচার করা হয়।’’ মধ্য এপ্রিলে রোদের এই দাপটের পিছনে দূষণ একটি বড় কারণ বলে মানছেন পরিবেশকর্মীরা। রাজ্য দূষণ পর্ষদের প্রাক্তন আইন আধিকারিক তথা পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নগরায়ণের জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। জলাশয়, পুকুর, জলাভূমি বুজিয়ে বহুতল তৈরি হচ্ছে। তার ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে।’’