ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন আতঙ্কিত এলাকাবাসী। বুধবার রাতে। — নিজস্ব চিত্র
রাজারহাট-নিউ টাউনের পরে এ বার তিলজলা। সিন্ডিকেট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এলাকা দখলের লড়াই। তার জেরেই কলকাতা শহরে ফের গুলি চলার অভিযোগ। সংঘর্ষ বাধল এলাকারই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। পুলিশ গণ্ডগোলের কথা স্বীকার করলেও গুলি চালানোর অভিযোগ তারা মানতে নারাজ।
ঘটনার সূত্রপাত বুধবার রাতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই এলাকা দখলের এই লড়াই চলছে। তার জেরেই ওই রাতে সাড়ে ১০টা নাগাদ তিলজলার কলোনি বাজার, এস এন রায় রোডের উপরে শুরু হয়েছিল দুই পাড়ার দুই গোষ্ঠীর খণ্ডযুদ্ধ। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাতেই এলাকায় বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করতে হয়। এলাকার প্রতিটি গলিতে টহল দিতে হয়েছে লাঠিধারী পুলিশকে। কখনও উত্তেজিত জনতাকে সরাতে তাড়াও করতে হয়েছে পুলিশকে। সাধারণ বাসিন্দারা ভয়ে সে সময়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে দেন।
বৃহস্পতিবার সকালেও তিলজলার ওই এলাকায় ছিল চাপা উত্তেজনা। দু’টি পাড়ার মোড়ে পুলিশি পাহারা। বাসিন্দারা কেউই অবশ্য আগের রাতের ঘটনা সম্পর্কে প্রকাশ্যে বেশি কিছু বলতে রাজি নন। কী হয়েছিল রাতে? এ প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর এসেছে, ‘‘আগে কোনও দিন এলাকায় গুলি চলতে দেখিনি। জানি না এ বার এখানে আরও কত কী দেখতে হবে!’’
আবার সুনীলনগর কলোনি এবং এস এন রায় রোড বস্তির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন বাসিন্দা জানান, এলাকায় প্রোমোটারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। আর তার দখলদারি নিয়েই সুনীলনগর কলোনির অপু দত্ত এবং এস এন রায় রোডের পাপ্পুর মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে গণ্ডগোল চলছে। কিন্তু পুলিশকর্তারা এই ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী জাভেদ খান অবশ্য দুই দলের মধ্যে গণ্ডগোলের কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছেন তিনি। বরং মন্ত্রী বলেন, ‘‘অপু সিপিএম করত। দলেরই কিছু ধান্দাবাজ ছেলেদের ধরে তৃণমূলে ঢোকার চেষ্টা করছে। তা নিয়েই দক্ষিণ কলকাতা যুব তৃণমূলের সম্পাদক সন্তোষ রায়ের সঙ্গে গোলমাল। পুলিশকে বলেছি দুই দলের অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করতে।’’
তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ২১ জুলাই দলনেত্রী যে বার্তা দিয়েছেন, দলের সকলকেই কঠোর ভাবে তা মেনে চলতে হবে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। যেখানে যেখানে অভিযোগ পাওয়া যাবে, প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, বুধবার রাতে কলোনি বাজার এলাকার বাসিন্দা এক মহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে মোটরবাইকে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন। অভিযোগ, সেই সময়ে এস এন রায় রোডের বাসিন্দা অজয় প্রসাদ ওরফে চোলাই পাপ্পু এবং তার দুই শাগরেদ একটি মোটরবাইকে চেপে এসে ওই দম্পতির পথ আটকায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দম্পতির অভিযোগ, পাপ্পু ওই মহিলাকে টেনে মোটরবাইক থেকে নামিয়ে দেয়। এর পরে তাঁর স্বামীর কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে প্রাণে মারার হুমকি দেয়। চেঁচামেচিতে কলোনি বাজারের আরও কিছু বাসিন্দা বেরিয়ে পড়লে পাপ্পুরা চম্পট দেয়। তবে স্থানীয়েরা সনৎ হালদার নামে এক জনকে ধরে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। খবর পেয়ে তিলজলা থানার পুলিশ গিয়ে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এর পরেই শূন্যে দুই রাউন্ড গুলি চালায় চোলাই পাপ্পু।
যদিও চোলাই পাপ্পুর পরিবারের অভিযোগ, তাঁদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। পাপ্পুর স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারারও চেষ্টা করা হয়। পাপ্পুর স্ত্রী লক্ষ্মী বলেন, ‘‘পাপ্পু বাড়িতেই ছিল না। সুনীলনগর কলোনির কয়েক জন লোক এসে আমাদের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল।’’
স্থানীয় সূত্রের খবর, গোলমালের মূল কারণ সুনীলনগর কলোনির বাসিন্দা অপু দত্ত এবং চোলাই পাপ্পুর এলাকা দখলের লড়াই কেন্দ্র করেই। দু’জনেই শাসকদলের দুই নেতার আশ্রিত বলেও অভিযোগ। তাই এলাকার সমস্ত প্রোমোটারি কার কথায় চলবে, তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই দু’জনের দলবলের মধ্যে গণ্ডগোল চলছে।
স্থানীয়েরা জানান, বুধবার রাতে যে দম্পতিকে চোলাই পাপ্পুরা পথ আটকেছিল, সেই ব্যক্তি অপুর ঘনিষ্ঠ বলেই স্থানীয় সূত্রের খবর। যদিও বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে অপু কিংবা পাপ্পুর কারওরই দেখা মেলেনি। তবে সুনীলনগর কলোনির একটি ক্লাবে গিয়ে অপুর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁরাও কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তাঁদের একমাত্র বক্তব্য, এই ঘটনার বিষয়ে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী জাভেদ খানকে অভিযোগ জানানো হবে।