সেরিব্রাল পলসি নিয়ে অদম্য লড়াই যুবকের

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৯ ০১:৫৬
Share:

পাশে: মায়ের সঙ্গে আকাশ চক্রবর্তী। বুধবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

ছেলের যেন সমস্যা না হয়! তাই পরীক্ষাকেন্দ্রের বেঞ্চের উপরে পেন, পেনসিলের সঙ্গে কয়েকটি পেনকিলার, ওষুধের বাক্স এবং ব্যথা কমানোর স্প্রে-র কৌটো সাজিয়ে দিচ্ছেন মা। ঘণ্টা চারেক পরে উচ্চ মাধ্যমিকের সে দিনের পরীক্ষা শেষে ক্রাচ হাতে ছেলে আকাশ চক্রবর্তী যখন বেরিয়ে আসছেন, মায়ের প্রশ্নের শেষ নেই। ‘‘শরীর খারাপ করছে না তো! জল খাবে? পরীক্ষা ভাল হয়েছে?’’ কোনও উত্তরই দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না ছেলের। স্কুলের বারান্দাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি।

Advertisement

জীবনের লড়াইয়ে অবশ্য বারবার উঠে দাঁড়িয়েছেন সেই ছেলে। বয়স যখন মাত্র তিন মাস, তখনই চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আকাশ সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। দীর্ঘ চিকিৎসা, হাঁটুতে অস্ত্রোপচার, শিরদাঁড়ার সমস্যা নিয়েও সিবিএসই-র দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ‘কিউমুলেটিভ গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ’-এ (সিজিপিএ) দশে দশ পান তিনি। ২০১৬ সালে ৯২ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা আকাশ এখন দেশের পাঁচটি রাজ্যের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) থেকে ডাক পেয়েছেন। পাশ করে কর্পোরেট সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগে যোগ দিতে চান বছর একুশের আকাশ। বলছেন, ‘‘অনেক বড় কোম্পানিতেই আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের চাকরি পেতে সমস্যা হয়। আমি বোঝাতে চাই, আমরাও পারি।’’ ছেলের কথা শুনে পাশে বসা মা বহ্নি চক্রবর্তী বলতে থাকেন, প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সেই সময়গুলির কথা।

বামুনগাছির বাসিন্দা আকাশেরা এখন বাগুইআটিতে থাকেন। ছোটবেলায় আকাশ কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারতেন না। ‘অন্য রকম’ দেখে প্রথম দিকে তাঁকে কোনও স্কুলই ভর্তি নিতে চায়নি। পরে নাগেরবাজারের একটি স্কুল তাঁকে ভর্তি নেয়। সেখানে কয়েক বছর পড়ার পরে সল্টলেকের হরিয়ানা বিদ্যামন্দির স্কুলে ‘আপার নার্সারি’-তে ভর্তি হন আকাশ। বহ্নি বলেন, ‘‘প্রথম থেকেই ওর চলাফেরায় সমস্যা হত। হাঁটু ভেঙে কোনও মতে চলত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে একদম বিছানায় পড়ে গেল। চলাফেরা একেবারে বন্ধ। হুইলচেয়ার কেনা হল আকাশের জন্য।’’ কলকাতার চিকিৎসকদের পরামর্শে আকাশকে নিয়ে যাওয়া হয় ভেলোরে। সেখানে তাঁর হাঁটুর অস্ত্রোপচার হয়। বহ্নির কথায়, ‘‘হাঁটুর অস্ত্রোপচার করে প্লাস্টার করে দিলেন চিকিৎসকেরা। ছেলে আমাদের সোজা হল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ওর প্রবল পিঠের ব্যথা শুরু হল।’’

Advertisement

তখন কোনও মতে স্কুলে যেতেন আকাশ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে না পারা ছাত্রের জন্য একতলার ঘরেই আলাদা ক্লাস নিতে শুরু করেন হরিয়ানা বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বহ্নি বললেন, ‘‘স্কুল পাশে না দাঁড়ালে হয়তো আকাশের এক বছর পড়া বন্ধ রাখতে হত...।’’ কথা শেষ না করেই বহ্নি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘‘তবে খুব সমস্যায় পড়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিকে। রাইটার নিয়ে মাধ্যমিক দিয়েছিল আকাশ। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে ওকে যে রাইটার দেওয়া হয়েছিল, তিনি কমার্সের লোক নন। আকাশ অঙ্কের সাইন বললে সেই রাইটার বুঝে নিয়ে লিখবেন কী করে, তা নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ি। আকাশ বলল, নিজেই লিখবে পরীক্ষায়।’’ ওই সময়েই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এক দিন স্কুলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান আকাশ। তবে লড়াই ছাড়েননি।

ঘরে উপস্থিত বাকিরা বলে ওঠেন, ‘‘ওর বাবা-মায়েরও কি কম লড়াই!’’ ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটাচলা করতে করতে মেরুদণ্ডে চোট ধরা পড়ে বহ্নির। অস্ত্রোপচার করাতে হয়। বাবা আশিস চক্রবর্তী একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। গত ১৮ বছর তিনি কোনও পদোন্নতি নেননি। তাঁর কথায়, ‘‘পদোন্নতি নিলেই বদলি হয়ে যেতে হতে পারে। ওর মায়ের উপরে আর কত চাপ দেব!’’

এর পরে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আকাশ যখন ছোট ছিল, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত কেউ ভাল আছে শুনলেই তাকে দেখতে যেতাম। মনে হত, আমাদের আকাশও ঠিক পারবে।’’ প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের মুখ জিজা ঘোষ বললেন, ‘‘দারুণ ব্যাপার। প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও বেশি করে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। আকাশকে অনেক শুভেচ্ছা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন