অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
সুনসান ভিআইপি রোড। মাঝেমধ্যে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে মোটরবাইক। তা ছাড়া, চার দিকে মানুষজন নজরে আসছে না বিশেষ। রাস্তায় আলো রয়েছে পর্যাপ্তই। তবে নিজেকে নিরাপদ মনে করানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।
রাত তখন প্রায় সাড়ে ১২টা। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। অফিস অন্য গাড়ি পাঠানো পর্যন্ত যাওয়ার উপায় নেই। তাই এমন পরিস্থিতি দেখেও কেষ্টপুর মোড়ে ভিআইপি রোডের ধারেই গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। ‘আমরা’ মানে আমি এবং তিন সহকর্মী। তাঁরা সকলেই পুরুষ (এ ক্ষেত্রে হয়তো এ কথার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক নয়)।
কোনও কোনও মোটরবাইক হাল্কা করে গতি কমাচ্ছে আমাদের কাছাকাছি এসে। গতি কমছে কিছু ট্যাক্সিরও। আসছে উড়ো কুপ্রস্তাব। ইশারা করে ট্যাক্সিতে উঠতে বলছে কেউ কেউ। অস্বস্তি বাড়ছে আমার।
মাঝেমধ্যে পাশ থেকে ধেয়ে আসছে দু’-একটি মোটরবাইক। হেলমেটহীন সওয়ারিরাও আমার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দু’টি মাত্র ট্যাক্সি, কেষ্টপুর সাবওয়ের কাছে। শুনেছি, রাতে নাকি ভিআইপি রোডে পুলিশের ভ্যান টহল দেয়। কিন্তু এত ক্ষণে এক বারও দেখা মিলল না পুলিশের।
অনেক ক্ষণ পরপর দেখা মিলছে দু’-একটি গাড়ির। দ্রুত গতিতে আসছে। রাস্তার ধারে দু’-এক জনকে নামাচ্ছে, আবার আমাদের পাশ কাটিয়ে তেমনই গতিতে চলে যাচ্ছে নিমেষে।
হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল একটি সাদা রঙের ঝাঁ-চকচকে গাড়ি। প্রায় আমার গা ঘেঁষে। গাড়িতে বসা তিন জন মাঝবয়সী লোক। দু’জন সামনের সিটে ও এক জন পিছনে। খুব বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে তারা আমার দিকে। এর পরেই শুরু হল কু-ইঙ্গিত। তাদের সঙ্গে যেতে বলার নানা ইশারা।
গাড়িতে বসে আমার দিকে চোখ রেখেই কী যেন আলোচনায় মাতল সাদা পাঞ্জাবি-জিন্সের মাঝবয়সীরা। হয়তো বা আমাকে গাড়িতেই তোলার মতলব আঁটছিল ওরা! সেই আলোচনায় গাড়ির চালক হয়তো রাজি হচ্ছিল না। সে হাসতে হাসতেই মাথা নেড়ে বারবার ‘না’ বলছিল। আমি ওদের দুঃসাহস দেখে হতবাক হয়ে যাই।
প্রচণ্ড ভয় করছে। আর বুঝি বাড়ি ফেরা হল না। ছোট্ট মেয়ের মুখটা চোখে ভাসছে। আর কি দেখা হবে ওর সঙ্গে? কার কাছে সাহায্য চাইব এত রাতে! অফিসে ফোন করেই খানিক চেঁচামিচি করতে থাকি। এক সহকর্মী একটু এগিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। তেমনটাই করি সকলে। সাদা গাড়ি কিন্তু নড়ছে না। নড়ছে না সওয়ারিদের নজরও। তিন জোড়া চোখের দৃষ্টিতে আমার অস্বস্তির পারদ বেড়ে চলেছে।
বেশ কিছু ক্ষণ পরে গাড়িটি স্টার্ট দিল। চলেও গেল। এতক্ষণ ধরে জমাট বেঁধে থাকা আতঙ্কটা কাটতে সময় লাগল। এত ক্ষণে শুধু এক বার চোখে পড়েছিল হু হু করে একটি পুলিশ-ভ্যানের চলে যাওয়া। তারা আদৌ কোনও নজরদারির জন্য ঘুরছিল, এমনটা এক বারও মনে হয়নি। তাই সেই পুলিশ-ভ্যান দেখে অভব্য গাড়িগুলিরও কোনও হেলদোল ছিল না।
অবশেষে এল অফিসের গাড়ি। এত ক্ষণে চল্লিশ মিনিট পার। কাটেনি আতঙ্কের রেশ।