দালাল-রাজ ঠেকাতে এ বার প্রযুক্তির দ্বারস্থ হচ্ছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পদ্ধতি এ বার অনলাইনে করার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য পরিবহণ দফতর। প্রাথমিক ভাবে বেহালায় পরিবহণ দফতরের যে নতুন দফতর তৈরি হচ্ছে, সেখানে কলকাতায় প্রথম এই পরিষেবা চালু করা হবে। পরে তা ধাপে ধাপে শহরের অন্যান্য জায়গায় এবং গোটা রাজ্যেই করা হবে বলে জানান পরিবহণ দফতরের এক কর্তা।
এক পরিবহণকর্তা জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেওয়া সবের জন্যই আবেদনকারীকে বিভিন্ন মোটর ভেহিক্লস অফিসে দৌড়তে হয়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই লাইসেন্স মেলে। আর আবেদনকারীদের ওই সময় বাঁচাতেই ঢুকে পড়েন দালালরা। তাঁরা বোঝান, টাকা দিলেই মুশকিল আসান!
লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে ফর্ম তোলা, জমা দেওয়ার ঝামেলা আর থাকে না। নিয়ম অনুযায়ী, ফর্ম জমা দিয়ে কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয় লাইসেন্স প্রার্থীকে। কিন্তু দালালদের কৃপায় সেখানে অনেকে সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও কাজ মিটে যায়। অনায়াসে পেয়ে যেতেন ‘লার্নার’ শংসাপত্র। লাইসেন্স পাওয়ার আগে যেটি দিয়ে অনায়াসে গাড়ি চালানো যায়। তার পরে সহজেই পাশ ট্রায়ালে। পরে লাইসেন্স। ব্যাস কেল্লা ফতে। দালাল ও লাইসেন্স প্রার্থী উভয়ই খুশি।
কিন্তু এ বার গোটা পরিস্থিতিটাই আমূল বদলে ফেলতে চাইছে সরকার। কী থাকছে নতুন ব্যবস্থায়?
ওই পরিবহণ কর্তা জানান, এখন লাইসেন্সের আবেদন করতে হবে অনেকটা পাসপোর্টের মতো অনলাইনে। যে কোনও কম্পিউটার, ট্যাব বা স্মার্ট ফোন থেকে অনায়াসেই পরিবহণ দফতরের ওয়েবসাইট খুলে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার আবেদনপত্র (বাংলা বা ইংরেজি) ‘ডাউনলোড’ করে তা পূরণ করতে হবে। পূরণ হওয়া ফর্ম পৌঁছনোর পরে পরিবহণ দফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে, কোথায় কখন যেতে হবে।
এর পরে নির্ধারিত দিনে মোটর ভেহিক্লস অফিসে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। সেই পরীক্ষাও হবে কম্পিউটারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, “প্রথমে কম্পিউটারে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে পরীক্ষার্থীকে। ১০টি প্রশ্নের জন্য থাকবে সাত মিনিট সময়। ওই কম্পিউটারই জানিয়ে দেবে ওই প্রার্থী উত্তীর্ণ কি না। উত্তীর্ণ হলে হাতে হাতে ‘লার্নার’ বা শিক্ষানবিশ শংসাপত্র দিয়ে দেওয়া হবে। তখনই জানিয়ে দেওয়া হবে, কবে ওই প্রার্থীর ‘ড্রাইভিং ট্রায়াল’ নেওয়া হবে।” ওই কর্তার দাবি, “এই প্রক্রিয়ার ফলে দালালদের ভূমিকা কার্যত মুছে যাবে।”
ওই কর্তা জানান, চূড়ান্ত পরীক্ষায় লাইসেন্সপ্রার্থীকে এইচ টেস্ট, গ্রেডিয়েন্ট টেস্ট এবং প্যারালাল পার্কিং টেস্ট দিতে হবে। মোটরবাইক এবং অটোচালককে দিতে হবে সারপেনটাইন টেস্ট। ওই পরীক্ষাগুলিও নেওয়া হবে কম্পিউটারের মাধ্যমে। কম্পিউটারই জানিয়ে দেবে ফলাফল। তাই চুরির কোনও সুযোগই নেই বলে দাবি ওই কর্তার। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, এই পরীক্ষা কেন্দ্র তৈরির জন্য প্রায় ছ’কোটি টাকা সাহায্য করছে কেন্দ্র।
যদিও এই পদ্ধতি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সিটুর ট্যাক্সি সংগঠনের নেতা প্রমোদ ঝায়ের কথায়, “অনেক চালকই কম্পিউটার চালাতে পারেন না। তাঁরা কী ভাবে ফর্ম পূরণ করবেন? পরীক্ষাই বা কী ভাবে দেবেন?” সিটুর দাবি, বর্তমানে অনেক বাস ও ট্যাক্সিচালক রয়েছেন, যাঁরা শুধু হিন্দি লিখতে-পড়তে পারেন। নতুন ভাবে এমন অনেকে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন, যাঁরা বাংলা বা ইংরেজি পড়তে পারেন না। তাঁদের কী হবে?
জবাবে পরিবহণ দফতরের অন্য এক কর্তা জানান, মোটর ভেহিক্লস আইন অনুযায়ী প্রত্যেক চালককে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাশ হতে হয়। তাই সে ক্ষেত্রে ইংরেজি বা বাংলায় ফর্ম পূরণে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আর কম্পিউটার চালানোর জন্য প্রার্থীকে সাহায্য করতে পরীক্ষার ঘরে উপস্থিত থাকবেন পরিবহণ দফতরের কর্মীরা। তবে হিন্দিতেও যে ফর্ম রাখার কথা ভাবা হচ্ছে, সে কথাও জানান ওই কর্তা।
তবে এর জেরে মাথায় হাত পড়েছে দালালদের। এক দালাল বলেই ফেললেন, “যদি সময় ব্যয় না করে সবাই লাইসেন্স পেয়ে যান, তবে আর আমাদের কেউ টাকা দেবেন কেন?” এর প্রেক্ষিতে এক পরিবহণকর্তার বক্তব্য, “পাসপোর্টও তো এখন অনলাইন। তা বলে কি আর দালালদের ভূমিকা নেই! এখানেও দালালেরা সেই ভূমিকাই পালন করবেন। তাঁদের পুরোপুরি তুলে দেওয়া মুশকিল।”