ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সকালে প্রাক্তন স্ত্রীকে কুপিয়ে খুন

রক্তাক্ত রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে এক যুবক। কোলের কাছে গলার নলি কাটা তরুণী। যুবকের হাতে রক্ত মাখা ছুরি। মেয়েটিকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছে, “আমি তোমাকে ভালবাসি।” পাশেই একনাগাড়ে কাঁদছে ছ’বছরের একটি শিশু। শনিবার, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র সকালে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ এই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিলেন তিলজলার গণেশ ঘোষ লেনের বাসিন্দারা। পুলিশ ঘটনাস্থলে যেতে আত্মসমর্পণ করে ওই যুবক নিজেই খুনের কথা কবুল করে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৩২
Share:

এখানেই খুন হন জিনত পরভিন। শনিবার, তিলজলায়। —নিজস্ব চিত্র

রক্তাক্ত রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে এক যুবক। কোলের কাছে গলার নলি কাটা তরুণী। যুবকের হাতে রক্ত মাখা ছুরি। মেয়েটিকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছে, “আমি তোমাকে ভালবাসি।” পাশেই একনাগাড়ে কাঁদছে ছ’বছরের একটি শিশু। শনিবার, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র সকালে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ এই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিলেন তিলজলার গণেশ ঘোষ লেনের বাসিন্দারা।

Advertisement

পুলিশ ঘটনাস্থলে যেতে আত্মসমর্পণ করে ওই যুবক নিজেই খুনের কথা কবুল করে। পুলিশ জানায়, ওই যুবকের নাম শেখ সাবির আলি। নিহত তরুণী জিনত পরভিনকে (২৪) খুনের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পেশায় রিকশাচালক সাবিরের বাড়ি তপসিয়া থানা এলাকায়। জিনত তিলজলার কবরডাঙায় থাকতেন।

কিন্তু কেন এই খুন?

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, একদা স্বামী-স্ত্রী সাবির ও জিনত এখন বিবাহ-বিচ্ছিন্ন। সাত বছর আগে দু’জনের বিয়ে হয়। তাঁদের একটি ছ’বছরের ছেলে ও তিন বছরের মেয়েও রয়েছে। বছর দু’য়েক আগে স্বামী-স্ত্রী থাকাকালীন সাবিরের বিরুদ্ধে একবালপুর থানায় নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন জিনত। তখন ওই এলাকাতেই থাকতেন তাঁরা। জিনতের পরিবারের অভিযোগ, সাবিরের বিরুদ্ধে তাঁকে মারধর করা ছাড়াও দেহব্যবসায় নামানোর অভিযোগ পর্যন্ত করেছিলেন জিনত। বিচ্ছেদের পরেও সাবিরের উৎপাত কমেনি। যখন-তখন চড়াও হয়ে সে নানা ধরনের জুলুম করত বলে পুলিশকে জানিয়েছেন জিনতের দাদা শেখ আব্দুল মাজাদ।

সম্প্রতি তাঁর দুই সন্তান, মা-বাবা ও দাদার সঙ্গে কবরডাঙার ভাড়া-বাড়িতে চলে আসেন জিনত। পুলিশের দাবি, অন্য কোনও পুরুষকে নিয়ে এর পরে জিনত ও সাবিরের মধ্যে গণ্ডগোল বাড়তে থাকে। যার পরিণতি এই মৃত্যু। জিনতের দাদা শেখ আব্দুল মাজাদ বলেন, ওদের ছাড়াছাড়ির পরেও বোনকে তিষ্ঠোতে দেয়নি সাবির। নিয়মিত হুমকি দিয়ে ছেলেমেয়েকে কেড়ে নিতে চাইত। বলত, বাচ্চাদের না দিলে প্রাণে মেরে দেব। “সেটাই সাবির করে দেখাল। আমার বোনটাকে মেরে ফেলল,” কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন আব্দুল।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, শনিবার বেলা ১১টা নাগাদ জিনত তাঁর ছ’বছরের ছেলে আমন আলিকে নিয়ে তিলজলা বাজারে গিয়েছিলেন। বাজার থেকে ফেরার সময়ে দেখা হয় সাবিরের সঙ্গে। সেখান থেকে কিছুটা দূরেই গণেশ ঘোষ লেন। কয়েক ফুটের সরু গলি। এক পাশে কয়েকটি নির্মীয়মাণ বাড়ি। আর এক পাশে উঁচু দেওয়াল। কিছুটা দূরেই একটি স্কুল। কিন্তু এ দিন স্কুল ছুটি হওয়ায় ফাঁকাই ছিল এলাকা। তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসার জানান, জিনত ও তাঁর পুত্র রাস্তা দিয়ে ফেরার সময়েই তক্কে-তক্কে ছিল সাবির। একাধিক ছুরি নিয়ে জিনতকে খতম করতে তৈরি ছিল সে।

পুলিশের দাবি, জিনতের দেহ খুঁটিয়ে দেখে বোঝা গিয়েছে, নৃশংস ভাবেই খুন করা হয় তাঁকে। গলার নলি কেটে নেওয়া ছাড়াও জিনতের বুকে এলোপাথাড়ি ছুরি বসানোর ক্ষত পাওয়া গিয়েছে।

জিনত পরভিন ও শেখ সাবির আলি

তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মারফত পুলিশ জানতে পেরেছে, খুনের পরে সাবিরের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ছুরি হাতে প্রাক্তন স্ত্রীর দেহ জড়িয়ে ঘটনাস্থলেই সে বসে পড়ে। পালানোর চেষ্টা করেনি। হাউ-হাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। এলাকাবাসীরা গলিতে ঢুকে পড়লেও সাবিরের ভাবান্তর হয়নি। পুলিশ এলে সে নিজেই জোড় হাতে খুনের কথা স্বীকার করে।

সাবিরের এই আচরণ বিশ্লেষণ করে তার ভিতরে জটিল মানসিক রোগের বীজ আছে বলেই মনে করছেন মনোবিদেরা। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের জেরে তার পৌরুষ আহত হওয়ার লক্ষণ আছে, সঙ্গে সাবিরের আরও কিছু বিকৃতির আভাসও পেয়েছেন তাঁরা। নীলাঞ্জনা সান্যালের পর্যবেক্ষণ, নিজের প্রবৃত্তির উপরে লাগাম হারিয়ে ফেলার এই প্রবণতা হল, এক ধরনের ‘ইমপাল্স কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার’। পরে অনুতাপ হলেও রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য এই মানসিক রোগীরা ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। জিনতকে সাবিরের নৃশংস ভাবে খুনের মধ্যে এই প্রবণতারই ছাপ রয়েছে। এ ছাড়া, বিবাহ-বিচ্ছেদের পরেও প্রাক্তন স্ত্রীর উপরে অধিকারবোধ থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যার পরিণতি ওই তরুণীর এই ভয়ঙ্কর মৃত্যু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন