ট্যাক্সির ছাদের ঘাসে জল দিচ্ছেন ধনঞ্জয়বাবু। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
ট্যাক্সি থেকে নামতেই চালক সবুজ রঙের একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন যাত্রীর দিকে। নানান আঁকিবুকির মাঝে লেখা চার লাইন।
ছুটছে আমার সবুজ রথ
বিছিয়ে দিতে স্নিগ্ধ পথ
ক’জন মোরা সবুজ সাথি
বার্তা দেব দিবারাতি।
এই বার্তা ধরিয়ে দিয়েই হলুদ ট্যাক্সিটি এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্যে।
ট্যাক্সির ছাদে একফালি সবুজ ঘাসের গালিচা— কলকাতা শহরের বুকে চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ‘সবুজ রথ’। পিচ গলানো রোদ্দুরে গাড়ির ভিতরে সবুজ ডালপালার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সবুজ রঙের আসনে বসা যাত্রীর প্রশান্ত মুখ। কোনও গল্পকথা নয়। রুক্ষশুষ্ক একটা বাস্তবের মধ্যে নতুন এক বাস্তবের সন্ধান দিচ্ছেন এই খাস কলকাতারই এক ট্যাক্সিচালক ধনঞ্জয় চক্রবর্তী।
১৪ বছর ধরে এই শহরে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন ধন়ঞ্জয়বাবু। নিজের চিকিত্সার প্রয়োজনে বছর আটেক আগে নিজের ট্যাক্সিটি বেচে দিতে বাধ্য হন তিনি। পরিচিত অমরিশ সিংহের গাড়িটিই চালাচ্ছেন সেই সময় থেকে। সাদামাটা ট্যাক্সিকে এ ভাবে সাজানোর ভাবনা প্রথম মাথায় আসে এক বন্ধুর কাছে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা একটা ছবি দেখে। “গাছপালা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয়। একটা সময় বহু রকমের বৃক্ষরোপন উত্সবে অংশ নিয়েছি। দেখেছি, গাছ লাগানো হয় বটে, কিন্তু যত্ন নেওয়া হয় না। ফলে গাছগুলো মরে যায়। তাই একটু অন্য রকম ভাবে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।”—জানালেন ধনঞ্জয়বাবু।
তাঁর ডাক নাম বাপি। তবে, পাড়ার বন্ধুদের কাছে ‘গেছোবাপি’ বলেই বেশি পরিচিত ধনঞ্জয়বাবু। তিনি বললেন, “ট্যাক্সির ছাদে প্রথম যখন প্রায় ৬৫ কেজির ভারী ট্রে বসাই, ভয় ছিল গাড়ির ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু, এমন ভাবে গোটাটা বানানো হয়েছে যাতে ওজনটা সমান ভাবে ছড়িয়ে আছে। উল্টে ঘাসের আস্তরণ থাকায় গাড়ির ভিতরটাও বেশ ঠান্ডা হয়ে থাকে।’’
বছর তিনেক আগে, এক রাতে ট্যাক্সির পিছনের আসনে একটা সুন্দর দেখতে বোতল কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তিনি। সুন্দর দেখতে বলে ফেলেও দিতে পারেননি। পর দিন সেটা পরিষ্কার করে ওতে একটা মানিপ্ল্যান্ট লাগিয়ে বোতলটা গাড়ির পিছনের আসনে বসিয়ে রাখেন তিনি। তাঁর কথায়: ‘‘কয়েক দিনের মধ্যেই দেখি ডালপালা বেরিয়ে গাছটা আরও সুন্দর হয়ে গিয়েছে। যাত্রীদেরও বেশ পছন্দ হয় বিষয়টা। তখন থেকেই গাছ লাগানোর তাগিদটা আরও বেড়ে যায়।’’
ধনঞ্জয়বাবু জানালেন, প্রথমে পাগলামি ভেবে মজা করতেন তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা। এমনকী সহকর্মীরাও। তবে, গাছের প্রতি এমন দুর্নিবার আকর্ষণের কাছে অবশ্য থেমে গিয়েছে সব কিছু। সবুজে সাজিয়েছেন টালিগঞ্জ-করুণাময়ীর ট্যাক্সিস্ট্যান্ডও। নিজের আঁকা ছবি, ছোট্ট কবিতা দিয়ে তৈরি করেছেন লিফলেট। সে সব বিলিয়ে দেন যাত্রীদের। শুধু লিফলেট নয়, আগ্রহী যাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন চারাগাছ, বীজও। ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টের নাম দিয়েছেন ‘বাপি গ্রিন ট্যাক্সি।’ বন্ধু সংখ্যা ইতিমধ্যেই ২৬৪।
“প্রথম প্রথম পুলিশ দেখলেই আটকাত। সন্দেহ করত যে, গাছের আড়ালে কোনও কিছু পাচার বা অন্য কিছু হচ্ছে কি না। এখনও দাঁড় করায়, তবে সন্দেহে নয়, আগ্রহে।”—বলেন ধনঞ্জয়বাবু। সহকর্মীদের মধ্যেও বাড়ছে উত্সাহ। ট্যাক্সি থেকে উপার্জনের অধিকাংশটাই খরচা করেন সবুজরথের পিছনে। সহকর্মীরা যদি আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাদের পাশেও সবটুকু সামর্থ নিয়ে দাঁড়াবেন বলে জানালেন তিনি।
ট্যাক্সিচালকের এমন উদ্যোগে উচ্ছ্বসিত পরিবেশকর্মী বনানী কক্কর। তিনি বলেন, “বাপির কথা শুনে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে এ রকমই এক মানুষের কথা। মুম্বই থেকে পুণে ট্রেনে যাতায়াত করতেন তিনি। আসা যাওয়ার রাস্তা জুড়ে জানলা থেকে বাইরে কেবলই বীজ ছড়াতে ছড়াতে যেতেন। তার থেকেই বেশ কিছু গাছ জন্মাত।” সবাই মিলে সবুজ পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে আত্মবিশ্বাসী সবুজরথের এই সারথি। যেখানে গাড়ির ধোঁয়ায় সারা ক্ষণই ভারী হয়ে আছে কলকাতার বাতাস, সেখানে সবুজরথ আর তার সারথি কলকাতাকে নতুন আকাশের সন্ধান দেবেন এ বিষয়ে আশাবাদী আরও অনেকেই।