প্রতীকী ছবি।
এমন লড়াই আগে দেখেনি বহরমপুর! বাংলাও না!
ডেভিড বনাম গোলিয়াথ!
বাইবেলের গল্পের সেই দ্বৈরথের সঙ্গে ভাগীরথীর পাড়ের বাস্তব লড়াইয়ের ফারাক আছে অবশ্য। গল্পের গোলিয়াথ বারংবার হুঙ্কার দিচ্ছে দেখে ডেভিড এগিয়ে গিয়েছিল তার মোকাবিলা করতে। এখানে গোলিয়াথকে আগেই ঘিরে দেওয়া হয়েছে মহাভারতের অভিমন্যুর মতো! পিছনে বড় সেনাপতি, তাঁর পিছনে আরও বড় সেনানায়িকা নিয়ে ডেভিড উদ্যত হয়েছেন গোলিয়াথ সংহারে।
কান্দি থেকে নওদা, ভরতপুর থেকে বহরমপুর— সাত বিধানসভা কেন্দ্র জুড়ে ডেভিডের ছবি আর পতাকায় ছয়লাপ। সরকারি জায়গা, ভোটযন্ত্র রাখার স্ট্রংরুম চত্বর, কোথাও বাদ নেই। বেশির ভাগ দেওয়ালে, পোস্টারেই ডেভিডের সঙ্গে সেনাপতির বড় ছবি। কুড়ি বছর এই মুলুকের নবাবি করে আসা গোলিয়াথ এই প্রচার-যুদ্ধে দৃশ্যতই পিছিয়ে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
চল্লিশ ডিগ্রি গরম, গনগনে রোদে ডেভিডের কপাল পুড়ে ঝামা। বলে রাখা যাক, এই ডেভিড আর গোলিয়াথের ঘরের মাঝে দরজা ছিল না এক কালে। ডেভিডের রাজনীতিতে আগমন গোলিয়াথের হাত ধরে। গোলিয়াথ বলে থাকতেন, ‘‘ওর বাড়ির ট্রাক ট্রাক চাল ধ্বংস করেছি আমি!’’ পুলিশ-প্রশাসন আর তৎকালীন শাসক সিপিএমের মহড়া নিতে নিতে রাজনীতির পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে থাকা গোলিয়াথের মায়ের শ্রাদ্ধ হয়েছিল ডেভিডের কান্দির বাড়িতে। জাতীয় কংগ্রেস যখন টিকিট দেয়নি, ‘কুঠার’ চিহ্নে নিজের হাতে জিতিয়ে এনে ডেভিডকে বিধানসভায় পাঠিয়েছিলেন গোলিয়াথই। কংগ্রেস থেকে টেনে এনে বিধানসভা থেকে ইস্তফা দিইয়ে কান্দি পুরসভার পরিচালক সেই ডেভিডকে তা হলে ‘গুরুমারা বিদ্যা’ প্রয়োগের দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর দলনেত্রী? তিন লক্ষ ৫৬ হাজার ভোটে হারা লোকসভা আসনে?
‘‘দীক্ষা তো নিইনি। গুরু বলব না! লিডার ছিলেন, আমি ক্যাডার হয়ে কাজ করেছি। যখন দেখলাম আমার লিডারের কাছে পৌঁছতে অন্য এক ভদ্রমহিলার মত ছাড়া হচ্ছে না, কান্দি পুরসভার জন্য টাকা বহরমপুরের সাংসদের তহবিল থেকে আসছে না, তখন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। বেইমান বলা যাবে না!’’ বলছেন অপূর্ব সরকার। ওরফে ডেভিড। বহরমপুরের মাঠে-ঘাটে এ বারের তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশ্যেই ‘মিসেস টেন পার্সেন্ট’ বলে আক্রমণ করছেন তাঁর প্রাক্তন লিডারের বর্তমান সহধর্মিনীকে! ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমণ নিয়ে চলে গিয়েছেন যে প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর সম্পর্কে পাল্টা কিছু কিন্তু গোলিয়াথের মুখে শোনা যাচ্ছে না! ‘‘আমার বিরুদ্ধে প্রার্থীটা আসলে কে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী না অন্য কেউ?’’ জানতে চাইছেন গোলিয়াথ। আসল নাম অধীর রঞ্জন চৌধুরী। সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ভোটে জিতেও পাঁচ বছরে ভাগীরথী দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়ে এখন চেনা তালুকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে যিনি নিজেকে আবিষ্কার করছেন!
এই অধীরের হাতে মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদ দূরস্থান, একটা পুরসভা, নিদেনপক্ষে একটা গ্রাম পঞ্চায়েতও নেই। লোকসভা কেন্দ্রের প্রায় ১৯০০ বুথের ৮০%-এ কংগ্রেসের এজেন্ট দেওয়ারই ক্ষমতা নেই বলে দাবি করছে তৃণমূল। রাতের অন্ধকারে কংগ্রেসের পতাকা, পোস্টার পুলিশকে পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে শাসক দল খুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ। নির্বাচন কমিশনকে বহু চিঠি দিয়েও পর্যবেক্ষকদের সাড়া নেই। পুলিশের খাতায় ফেরার থেকে এলাকায় টেপ করা ভাষণ শুনিয়ে বিধানসভা ভোট জিতেছিলেন যে অধীর, তাঁর জন্য এ বারের লড়াই কি আরও কঠিন? মধ্যরাতে বহরমপুরের কংগ্রেস দফতরে হাসছেন চার বারের সাংসদ। ‘‘সম্মানিত মনে করছি! মুখ্যমন্ত্রী, অন্য এক মন্ত্রী, পুলিশ-প্রশাসন— সবাই চাইছেন আমাকে হারাতে। পুরসভা, পঞ্চায়েত, তথাকথিত সংগঠন কিছু নেই। আমি একা! বিরুদ্ধে একটা গোটা সরকার। অসম যুদ্ধ একটা। বেশ তো!’’
চক্রব্যুহের মুখে প্রচারের ধরনটাই বদলে নিয়েছেন অধীর। দিনে ১২-১৩টা সভা করার সেই রুটিন পাল্টে এ বার প্রথম দিকে মূলত গ্রামের পর গ্রাম পরিক্রমা, শেষে শহর। পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না পারা আতঙ্কিত মানুষের কাছে শুধু চেহারাটা দেখাচ্ছেন— আমি আছি!পালাইনি! যেখানে মাইক ধরছেন, বিজেপি আর তৃণমূলের বিরোধিতায় চোখা চোখা কিছু লাইন। রাত সাড়ে ১০টায় তাঁর গাড়়ি দেখে কলোনির মহিলারা এগিয়ে আসছেন হইহই করে। তাঁকে ধাওয়া করে এসে মধ্যরাতে কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিচ্ছেন বড়ঞার এক দঙ্গল তৃণমূল কর্মী। আটপৌরে মানুষগুলোর মুখে একটাই কথা, ভোটটা দিতে চাই।
কোথায় কী ভাবে ভোট করা হবে, শহরে ঘাঁটি গেড়ে থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সেই ঘুঁটিই সাজাচ্ছেন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘দলনেত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন, পালন করছি। কাঁথির বিধায়ক থাকার সময়ে জঙ্গলমহলে কী করেছিলাম, মনে নেই?’’ তাঁর ভরসাতেই গোলিয়াথ-বধের অঙ্ক সহজ করার চেষ্টায় আছেন ডেভিড।
কষা অঙ্ক আবার কঠিন করে দেওয়ার মতো দু’টো ব্যাপারও আছে অবশ্য। অধীরের বিপুল জয়ের নির্বাচনেও গত বার ১৯.৫৪% ভোট পেয়েছিল বামফ্রন্ট। আরএসপি-র ঈদ মহম্মদ বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ভেঙে প্রার্থী হয়ে গেলেও তাঁর বেলচা-কোদালে কতটুকু ভোট উঠবে, তা নিয়ে কোনও জল্পনা নেই। সিপিএম-সহ বামেদের বাকি ভোটটা অধীরের হাতেই। আরএসএসের মনোনীত কৃষ্ণ জোয়ারদার আর্য লড়ছেন পদ্ম প্রতীকে, নরেন্দ্র মোদী আর অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছবি নিয়ে। কিন্তু না আছে তাঁর প্রচারে সাড়া, না আছে এখানে বিজেপি নামক কোনও হাওয়া। তৃণমূল-বিরোধী ভোটের তাই এক দিকেই ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনা।
পঞ্চায়েত ভোটে লাঠি-বাঁশের ঘায়ে কংগ্রেস বিধায়ককে মনোজ চক্রবর্তীকে হাসপাতালে যেতে দেখেছিল বহরমপুর। সেই বিধায়কই রাস্তার মোড়ে মোড়ে বক্তৃতা করছেন, ‘‘যদি দেখেন মনোজ চক্রবর্তী মারা গিয়েছে, তার রক্ত কুকুরে চেটে খাচ্ছে, তবু ভোটটা দিতে যাবেন!’’ এক যুগ আগে অধীরের দুই ‘কুঠার’ধারীর এক জন ডেভিড যখন অন্য শিবিরে, অন্য জন মনোজ দাঁড়িয়েছেন প্রথম জনের পথ আগলে।
এমন লড়াই আগে দেখেছে বাংলা?