পথে ভেন্ন দুই রাজ্য একাকার জীবনপথে

নয়াগ্রামের খড়িকামাথানি চক থেকে কিলোমিটার পাঁচেক চলার পরে সেই রাস্তায় পা রাখতেই থমকাতে হল।

Advertisement

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

নয়াগ্রাম শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৩৬
Share:

পরবাসী: দোরে বিজেডি-র পতাকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

দু'টি পাড়ায় বড়ই কাছাকাছি, মাঝে শুধু এক রাস্তার ফাঁক...

Advertisement

এক ফালি সেই পিচ রাস্তাই গড়ে দিয়েছে সীমানা।

নয়াগ্রামের খড়িকামাথানি চক থেকে কিলোমিটার পাঁচেক চলার পরে সেই রাস্তায় পা রাখতেই থমকাতে হল। ডান দিকে আটপৌরে মাটির বাড়ির বেড়ার দরজার এক পাশে পদ্ম-পতাকা, অন্য দিকে উড়ছে গাঢ় সবুজ এক পতাকা, মাঝে উজ্জ্বল সাদা শঙ্খ।

Advertisement

ভোট বাংলায় অচেনা এই পতাকা এখানে কী করছে? কৌতূহল নিয়েই পা রাখলাম মনোতোষ মাহাতোর উঠোনে। পতাকার কথা জানতে চাইতে বছর চল্লিশের যুবক বললেন, ‘‘ও তো আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দলের পতাকা।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আবার বিস্ময়! ঘাসফুল, শাঁখের তালগোল পাকিয়ে যাওয়া হিসেব স্পষ্ট হল মনোতোষেরই জবাবে। জানালেন, এক ফালি ওই রাস্তাই ফারাক গড়ে দিয়েছে। তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, নবীন পট্টনায়ক।

পড়াশোনা, দোকান-বাজার রুটিরুজি– মনোতোষদের সবই এই বাংলায়। শুধু ঠিকানাটা ওড়িশার। আর তাই ওঁরা ভোট দেবেন ওড়িশায়, লোকসভা কেন্দ্র বালেশ্বর। পড়শি এই রাজ্যে এখন বিধানসভারও ভোট।

সরু পিচ রাস্তার দু’ধারে দু’টি গ্রাম, ঝাড়গ্রাম জেলার নয়াগ্রাম এলাকার চুনখুলিয়া আর ওড়িশার বালেশ্বরের গোপীনাথপুর। মনোতোষ মাহাতোদের মতো পাঁচটি পরিবারের ভিটে রয়েছে ওড়িশার মাটিতে। ভোটার সাকুল্যে তিরিশ। মনোতোষ পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি। বাবা-ভাই নিয়ে পরিবার। মনোতোষ বললেন, ‘‘আমাদের ওই ঠিকানাটুকুই ওড়িশার। কাজ-কারবার, লেখাপড়া সবই এই বেঙ্গলে।’’ রোগভোগে ওঁরা ছোটেন নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটিতে, হাটবাজার খড়িকামাথানিতে। মনোতোষের বাবা কানাই মাহাতো তাও ওড়িয়া লিখতে-পড়তে পারেন। মনোতোষ ও তাঁর ভাই পরিতোষ সেটুকুও পারেন না। তাঁদের সবই বাংলায়।

নয়াগ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী সঞ্চিতা ঘোষ অবশ্য জানালেন, ওড়িশার মাটিতে থাকলেও ওই সব পরিবারের নতুন প্রজন্মের অনকের এখন এ রাজ্যের ভোটার কার্ড হয়েছে। ফলে, রেশনে দু'টাকা কেজি চাল ঢুকছে বাড়িতে। আর জঙ্গলমহলের স্কুলে পড়ার সুবাদে ছেলেমেয়েরা পাচ্ছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী।

যে রাজ্যের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি পরত জড়িয়ে সেখানে ভোট দিতে পারেন না বলে কি খারাপ লাগে? মনোতোষ বলেন, ‘‘খচখচ একটা করে বটে। বন্ধুবান্ধবরা সব বেঙ্গলের ভোট নিয়ে কথা বলে। তবে সে সবে আমাদের মন লাগে না।’’ উল্টো দিকে চুনখুলিয়ারও ওড়িশার ভোটে মন নেই। মাটির দেওয়ালে ঘাসফুল আর পদ্মের ছড়াছড়ি। সন্ধের মুখে মাহাতো পাড়ার তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বলছে, শাঁখ বাজছে৷ তবে নবীন পট্টনায়েকের দল বিজু জনতা দলের (বিজেডি) প্রতীক শাঁখে তাঁদেরও আগ্রহ নেই।

দু'রাজ্যের সীমানার এই ফারাক অবশ্য রাজনীতিতেই আটকে থাকে৷ রোজকার বেঁচে থাকা, পালাপার্বণ, এমনকি খুঁটিনাটি ঝগড়াতেও দু’পারের মাহাতো পাড়ার উঠোন এক হয়ে যায়। ছেলের দল দাপিয়ে বেড়ায় দু'দিকেই। এ গ্রামের হাঁস-মুরগি চরে বেড়ায় ও গ্রামে, ঝরা পাতাও পিচ রাস্তার সীমানা মানে না।

‘দেশের ভিতর বন্দি দেশও ঘুমায় অকাতরে!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন