Mahua Moitra

Santipur By-electtion: কী করে আমরা শান্তিপুর জিতলাম

এই লেখার যথার্থ শিরোনাম হতে পারে ‘আনহোনি কো হোনি কর না’। অর্থাৎ, অসাধ্যসাধন। অসাধ্যের নাম ‘শান্তিপুর’।

Advertisement

মহুয়া মৈত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২১ ২০:০৪
Share:

আধ্যাত্মিকতা এবং আধুনিক চিন্তাধারার অদ্ভুত মিশেল ছিল আমাদের প্রার্থী ব্রজকিশোরের মধ্যে।

এই লেখার যথার্থ শিরোনাম হতে পারে ‘আনহোনি কো হোনি কর না’। অর্থাৎ, অসাধ্যসাধন। অসাধ্যের নাম ‘শান্তিপুর’। যেখানে গত বিধানসভা ভোটে প্রায় ১৬ হাজার ভোটে জিতেছিল বিজেপি। সেই অসাধ্য সাধনের নামও ‘শান্তিপুর’। যেখানে মঙ্গলবার সাড়ে ৬৪ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতলাম আমরা।

কী ভাবে শান্তিপুরের অসাধ্যসাধন হল, সেটাই জয়ের ২৪ ঘণ্টা পর আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য লিখতে বসেছি।

অক্টোবরের ৩ তারিখে ভবানীপুরে মমতা’দি বিপুল ভোটে জিতলেন। সে দিন সন্ধেবেলা মমতা’দির বাড়িতে গিয়েছি অভিনন্দন জানাতে। তার কিছু ক্ষণ আগেই রাজ্যের বাকি চার আসনে উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মমতা’দি অফিসঘরে বসেছিলেন। পিছনে ওঁর বইপত্তর। খুব চনমনে লাগছিল ওঁকে। ঘরে পুরো আড্ডার মেজাজ। রাজদীপ সরদেশাই, ববি’দা রয়েছে। অভিষেক রয়েছে। আছেন আরও কয়েক জন। চা খেতে খেতে আড্ডা চলছে।

Advertisement

আমি বাইরে থেকে মুখটা বাড়াতেই মমতা’দি আমাকে ডেকে নিলেন। পাশে গিয়ে বসলাম। সবে চায়ে চুমুক দিয়েছি কি দিইনি, মমতা’দি বললেন, ‘‘আর মহুয়া, তুমি শান্তিপুরের ইলেকশনটা করো। একদম তোমার স্টাইলে বুথ টু বুথ জিততে হবে।’’ শুনে আমার তো অবস্থা খারাপ! প্রথমেই মনে হল, আমি তো ইংল্যান্ড যাওয়ার টিকিট কেটে ফেলেছি। ৮ অক্টোবর যাওয়ার কথা। কিন্তু তার সঙ্গে দিদির কী যায় আসে! আমি কিছু বলার আগেই মমতা’দি পাশের ঘর থেকে বক্সীদাকে ডেকে পাঠালেন। সুব্রত বক্সীকে নেত্রী বললেন, ‘‘বক্সীদা, মহুয়া শান্তিপুরটা করবে!’’

এত আচমকা সবটা হল, আমি তো চা খেতেই ভুলে গিয়েছিলাম। একটু ধাতস্থ হয়ে ফের চায়ে চুমুক দিলাম। মনের মধ্যে তখন ভাবনার সাগর। কী করে টিকিট ক্যানসেল করব! ইংল্যান্ড তো যাওয়াই হবে না। ভোটের বাকি আর মাত্র ২০ দিন। স্ট্র্যাটেজিটাই বা সাজাব কী করে!

Advertisement

তবে সেই রাতের মধ্যে আমি দুটো বিষয়েই মোটামুটি প্রাথমিক ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়েছিলাম।

ব্রজকিশোরের প্রচারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহুয়া

পরদিন সকালেই করিমপুর। টিমের সবাইকে ডেকে পাঠালাম। বললাম, ব্যাগপত্তর তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেল। আমরা ভোট করতে শান্তিপুর যাচ্ছি। ৩০ তারিখ পর্যন্ত ওখানেই থাকতে হবে। সব্বাই তো ভীষণ উত্তেজিত। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমি দলের নদিয়া জেলার সভাপতি ছিলাম। ফলে শান্তিপুর ভাল করেই চেনা। অজয়’দার (দে) মৃত্যু আর অরিন্দম (ভট্টাচার্য)-এর হেরে যাওয়ার পর শান্তিপুরে নেতৃত্বের একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। সেটাও জানতাম। গত মে মাসেই তো আমরা শান্তিপুরে ১৬ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছি। তবে এটাও জানতাম, শান্তিপুর চিরকাল অ-বামপন্থী। ভরপুর বাম আমলেও এখান থেকে কংগ্রেস জিতেছে। ৬টা পঞ্চায়েত আর শান্তিপুর পুর এলাকায় অসাধারণ সব কর্মীরা ছিলেন, আছেন। দিদি যাঁকে প্রার্থী বেছেছেন সেই ব্রজকিশোর গোস্বামীদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। নদিয়ার সবচেয়ে পুরনো পরিবারগুলোর মধ্যে একটা। চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত দেবের বংশধর তিনি। আধ্যাত্মিকতা এবং আধুনিক চিন্তাধারার অদ্ভুত মিশেল রয়েছে তাঁর মধ্যে। তরুণ এবং প্রাণোচ্ছল। ভোটে জেতার জন্য অসাধারণ একটা কম্বিনেশন।

শান্তিপুরে গিয়ে উঠলাম একটা গেস্ট হাউসে। ৬ থেকে ১০ অক্টোবর সেখানেই একটা কোনার দিকে ঘরে কাটালাম। শান্তিপুর শহর তো বটেই, সব ক’টা পঞ্চায়েতের কর্মীদের সঙ্গে মিটিং করলাম। আমার ধারণা একদম ঠিক ছিল। কর্মীদের প্রত্যেকে জেতার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী। মমতা’দিকে ওঁরা দক্ষিণ নদিয়ার এই আসনটা উপহার দিতে চান। আমরা ঠিক করলাম, প্রচার একেবারে সাদামাটা ভাবে হবে। ওপরে দিদি। আর নীচে কর্মীরা। মাঝখানে কেউ না। কোনও বড় মিটিং নয়। কোনও জাঁকজমক নয়। শুধু এটুকু নিশ্চিত করতে হবে, প্রার্থী যেন ২৬৪টা বুথের প্রত্যেকটায় পৌঁছতে পারেন। ভোটারদের সঙ্গে যেন তিনি দেখা করেন। আর কর্মীদের বলা হল, তাঁরা যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে দেখা করে মমতা’দির উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেন।

পুজোর চার দিন আমরা ছুটি নিয়েছিলাম। দশমীর রাতে ফের শান্তিপুরে ফিরি। সবাই ওই একই গেস্ট হাউসে ছিলাম। আস্তে আস্তে সেটা যেন কলেজের হস্টেলের মতো হয়ে উঠল। কেউ রান্নার জন্য মাছ কিনে আনছে। কেউ আবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে নারকেলের নাড়ু।

আমাদের সকাল শুরু হত ৯টায়। রোজ একটা করে পঞ্চায়েত বেছে নেওয়া হত। তার পর একটা হুডখোলা জিপে করে সেই পঞ্চায়েতের প্রত্যেকটা বুথে ঘুরে বেড়ানো। লাঞ্চের একটা বিরতি। তার পর শান্তিপুর শহরে ফিরে এসে হুড খোলা একটা টোটোয় একই ভাবে বুথ বেছে নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলা। সন্ধেবেলা আমরা মিটিং করতাম একটা করে ওয়ার্ড আর গ্রামে। প্রত্যেকটা পঞ্চায়েতের জন্য এক জন করে অবজার্ভার। তাঁর দায়িত্ব, ওই পঞ্চায়েতের প্রত্যেকটা বুথে আমাদের পরিকল্পনা কার্যকর করা। ২৩ অক্টোবর থেকে প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত— চার দিন একটা টেম্পো চেপে মিটিংয়ে যাওয়া আর প্রচার। সেখানে কলকাতা থেকে আসা নেতৃত্বও থাকতেন।

২৬ তারিখের মধ্যে আমরা প্রত্যেকটা বুথ কভার করে ফেলি। আমাদের কর্মীরা তত দিনে ময়দান গরম করে ফেলেছেন। ২৭ তারিখ অর্থাৎ প্রচারের শেষ দিন আমরা একেবারে প্ল্যান করে প্রত্যেক বুথে মিছিলের আয়োজন করেছিলাম। স্থানীয় উদ্যোগেই ওই মিছিল হয়।

জয়ের অনুভূতি সব সময়েই মিষ্টি হয়। কর্মীদের মনে কানায় কানায় উচ্ছ্বাস।

৩০ অক্টোবর অর্থাৎ ভোটের দিন সকাল ৬টার মধ্যে আমাদের এজেন্টরা বুথে পৌঁছে গেলেন। কমিশন বুথ থেকে যত দূরে ক্যাম্প করার অনুমতি দিয়েছিল, সেখানেও দু’জন করে বসলেন। একটা ওয়ার রুমও তৈরি করা হল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় হিসাব করা হচ্ছিল, কত জন ভোট দিলেন। আর কত বাকি। যাতে ভোট দেওয়ার হার বেশি হয়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছিল। কোথাও কোনও গন্ডগোল হয়নি। সবটাই খুব মসৃণ ভাবে হয়েছে। সন্ধে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ৭৯.৬ শতাংশ ভোট পড়ে। যে চার কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে কিন্তু শান্তিপুরে। রাত ১১টার মধ্যে আমরা সব ১৭সি ফর্ম সংগ্রহ করে ফেলি। হিসেবও করা হয়। জেতা নিয়ে কোনও সংশয়ই ছিল না। শুধু প্রশ্ন ছিল, কত ভোটে?

ভোটগণনার আগের রাতে আমরা সবাই শান্তিপুর পার্টি অফিসে দেখা করি। সেখান থেকে রানাঘাট। দলের কর্মীরা ওখানে একটা সুন্দর লজের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর হ্যাঁ, অসম্ভব ভাল ডিনারও। তাড়াতাড়ি শুতে গিয়েছিলাম রাতে। উঠলাম ভোর সাড়ে ৫টায়। রুটি-আলুভাজা খেয়ে সাড়ে ৬টার মধ্যে গণনাকেন্দ্রে পৌঁছে যাই। প্রথম রাউন্ডে গয়েশপুর। প্রত্যাশিত ভাবেই ৬,৬০০-র লিড। অদ্ভুত শান্তি। সেকেন্ড রাউন্ড বাঘআঁচড়া— কয়েক মাস আগে এই পঞ্চায়েতেই আমরা প্রায় ৪,৫০০ ভোটে হেরেছিলাম। সেখানেও ৩৬৭ ভোটের লিড। তখনই বুঝে গিয়েছি, জোয়ার আসছে। আর পেছনে তাকানোর কোনও গল্প নেই। বাবলায় প্রায় ৫,০০০ ভোটে হেরেছিলাম। সেখানেও ৫,২০০ ভোটের লিড। হরিপুর ২,৯০০ ভোটের হার থেকে ৬,৬০০ ভোটের লিড। বেলঘরিয়া ১ এবং ২— দুটোতেই হার ছিল। সেখানেও ১০ হাজারের বেশি লিড। শান্তিপুর শহর যখন গোনা শুরু হচ্ছে, লিড সামান্য। ধীরে ধীরে সেখানেও লিডের জোয়ার। শহর থেকে ৩৪ হাজারের লিড। আর পঞ্চায়েত এলাকায় ৩০ হাজার। ভাবা যায়! আমরা প্রত্যেকটা গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছি। আর পুরসভার ২৪ টা ওয়ার্ডের মধ্যে ২৩টায়।

জয়ের অনুভূতি সব সময়েই মিষ্টি হয়। কর্মীদের মনে কানায় কানায় উচ্ছ্বাস। ওঁদের মনে সেই কনফিডেন্স তত ক্ষণে এসেছে, ‘‘আর কোনও দিন আমরা শান্তিপুর হারব না।’’ এটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আর এটাই মমতা’দির ম্যাজিক। কখনও হাল ছেড়ে দেন না। তৃণমূল পরিবারের এক জন সদস্য হিসেবে আমি ভীষণ, ভীষণই গর্বিত। শুধু তা-ই নয়, বিজেপি যে ভারত-আত্মাকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অংশ হতে পেরেও আমি আনন্দিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন