দার্জিলিঙে প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় নিয়ে আরও এক বার কেন্দ্রের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি, উষ্মা প্রকাশ করলেন সেচ দফতরের ভূমিকা নিয়েও। মমতার মতে, ঠিক মতো কাজ করতে পারছে না সেচ দফতর। আপাতত যে কোনও কাজে হাত দেওয়ার আগে পূর্ত দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে রাজ্যের জলসম্পদমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার দফতরকে।
বুধবার দুপুরে দার্জিলিঙের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে উত্তরবঙ্গে বন্যা বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ানের পাশাপাশি ডিভিসির প্রসঙ্গও তুলতে শোনা গিয়েছে মমতাকে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রকৃতিকে নিয়ে খেলা যায় না। নদীকে নিজের মতো বইতে দিতে হয়। হয় ড্রেজ়িং করো, নয়তো বাঁধ ভেঙে দাও।’’ এক দিকে ড্রেজ়িং না করা, অন্য দিকে রাজ্যের মাইথন, পাঞ্চেতের মতো জলাধার থেকে জল ছাড়ার কারণে ‘ম্যানমেড’ বন্যাপরিস্থিতি তৈরি হওয়া নিয়ে অতীতেও একই সুর শোনা গিয়েছে মমতার মুখে।
উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতির জন্য বুধবার আরও এক বার ভুটানকে দায়ী করেন মমতা। উল্লেখ্য, দিন দুয়েক আগেই মমতা বলেছিলেন, ভুটানের জলেই এত বড় দুর্যোগ হয়েছে উত্তরবঙ্গে। তাই ভুটানের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বাংলাকে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজ্যের চাপে আগামী ১৬ অক্টোবর এ নিয়ে একটি বৈঠকও ডেকেছে কেন্দ্র। তাতে রাজ্যের এক আধিকারিককে পাঠানোর কথা রয়েছে। বুধবার মমতা ফের বলেন, ‘‘যে-ই যাক, বলতে হবে ওদেরও ক্ষতিপূরণ দিতে। বাংলার সদস্য থাকতে হবে। ওদের বাঁধের জল যাতে এখানে ঢুকে বাংলার ক্ষতি করতে না পারে, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কেন বার বার আমরাই ভুক্তভোগী হব?’’
মানসের দফতর নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘সেচ দফতর কাজটা ঠিক মতো করতে পারছে না। সেচ দফতর যা করবে, পূর্ত দফতরের সঙ্গে পরামর্শ করে করতে হবে। ম্যানগ্রোভ লাগানোর কাজে হাত দিতে হবে বন দফতরকে।’’ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়ে মমতা জানিয়েছেন, উত্তরের জেলাগুলির মধ্যে দার্জিলিংই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষত মিরিক। রোহিণীর রাস্তায় ধস নেমে বড়সড় ক্ষতি হয়েছে। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করছেন। ওই রাস্তা সারাতে অন্তত ২০-২৫ দিন লাগবে। তত দিন যাতায়াতের জন্য তিনধারিয়া রোড আর পাঙ্খাবাড়ি রোড ব্যবহার করা যাবে। মমতা জানিয়েছেন, দুধিয়ায় যে অস্থায়ী হিউম পাইপ ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, সেটাও আর সাত দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। তা ছাড়া, পাশে আর একটি পাকা সেতু তৈরি করা হচ্ছে। একটা সেতু তৈরি করতে দু’-আড়াই বছর সময় লাগে। পূর্ত দফতর, দমকল থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন— সকলেই দিনরাত কাজ করছেন। এমনটাই বক্তব্য মমতার।
মমতা জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গের দুর্যোগে সব মিলিয়ে মারা গিয়েছেন ৩২ জন। দার্জিলিঙে ২১, জলপাইগুড়িতে ৯ এবং কোচবিহারে ২ জন মারা গিয়েছেন। মৃত সকলের পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকা করে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারের এক জনকে স্পেশ্যাল হোমগার্ডের চাকরিও দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র দার্জিলিঙেই ৯টি ব্লক, চারটি পুরসভার প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করতে মোট ৩৭টি ত্রাণশিবির গড়া হয়েছে। ২০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিরাপদ জায়গায়। এখনও ছ’হাজারেরও বেশি মানুষ শিবিরে রয়েছেন। শুধুমাত্র দার্জিলিঙেই ১৩০০-র বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। শুরুতে ৩০ হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছিল। এখনও দিনে গড়ে ৭৫০ জন ত্রাণশিবিরগুলিতে আসছেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
পাশাপাশি, যাদের যা যা জরুরি নথিপত্র হারিয়ে গিয়েছে, সেগুলির প্রতিলিপি বা ডুপ্লিকেট তৈরি করে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণের কাজও চলছে। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র জেলা প্রশাসনের তরফেই ১৬ হাজার কিট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, শাসকদলের উদ্যোগেও ত্রাণসামগ্রী বিলি করা হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিমধ্যেই রাজ্যের তরফে একটি পৃথক তহবিল গড়া হয়েছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ নামে ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যে কেউ চাইলে অর্থসাহায্য করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
বুধবার কেন্দ্রের প্রতিও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘এ বারের দুর্যোগে যাঁদের বাড়ি ভেঙেছে, তাঁদেরকেও ডিসেম্বরে বাংলার বাড়ির টাকা দেওয়া হবে। এই টাকা আসবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার টাকা থেকে। তাই যার যতটুকু সম্ভব সাহায্য করুন। না করলেও ক্ষতি নেই। গত পাঁচ বছর ধরে আবাস যোজনার টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। ১০০ দিনের টাকা, গ্রামীণ রাস্তা, সর্ব শিক্ষা মিশন, জল স্বপ্নের টাকাও বন্ধ। কিন্তু সামলাচ্ছি তো!’’