কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ মতুয়া সম্প্রদায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মতুয়াদের প্রসঙ্গে নদিয়ার কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সাম্প্রতিক মন্তব্যে বিরক্ত ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি! পরিস্থিতি এমন যে ঠাকুরবাড়ির বিবদমান দুই শিবিরই এক সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর যে মহুয়ার এই মন্তব্যকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘হাতিয়ার’ করতে চাইবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের শিবিরও মহুয়ার ‘বেফাঁস’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে।
বিতর্কের সূত্রপাত কৃষ্ণনগরের এক সভা থেকে। সম্প্রতি ওই সভায় মহুয়াকে বলতে শোনা যায়, “সারা বছর তৃণমূল। আর ভোটের সময় সনাতনী। এটা কী অঙ্ক ভাই?” লক্ষ্মীর ভান্ডারের সুবিধার কথাও সেই মঞ্চ থেকে বলেন মহুয়া। মনে করিয়ে দেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারে অন্যদের তুলনায় তফসিলি জাতি, জনজাতির মহিলারা বেশি টাকা পান। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, এর পরেও মতুয়া প্রধান বিভিন্ন বুথে অন্য দলকে ভোট দেওয়া হয়। মহুয়ার কথায় ওই বুথগুলিতে, ১০০টি ভোটের মধ্যে ৮৫টি যায় বিজেপিতে এবং ১৫টি যায় অন্য দলে। এর পরে তৃণমূল সাংসদ আরও বলেন, “কাজের সময় মমতা, রাস্তার সময় মমতা৷ কাঠের মালা পরে সব তো চলে আসেন ভাই ভাতা নিতে? তখন কী হয়? আমার কথা নিয়ে টিভিতে দেখানো হয়, ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে৷ আমার কিছু যায় আসে না।”
মতুয়াদের সম্পর্কে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদের এই মন্তব্য ‘অপমানজনক’ বলেই মনে করছেন সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু। ওই ভাতা যে সরকারি অর্থ এবং কারও নিজস্ব কোষাগার থেকে যাচ্ছে না, তা-ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। শান্তনুর কথায়, “ওটা তৃণমূলের ভাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভাতা৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মহুয়া মৈত্র কেউ নিজের ঘর থেকে ভাতা দিচ্ছেন না৷ সরকারের টাকা সাধারণ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে৷ মহুয়া মৈত্র মতুয়া নন৷ তিনি মতুয়াদের সম্পর্কে যে সকল কথা বলছেন, তা অপমানজনক।”
আগামী বছরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বার বার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উঠে এসেছে। বনগাঁ এবং রানাঘাট— এই দুই জায়গাতেই মতুয়া ভোটারের সংখ্যা যথেষ্ট। এ ছাড়া রাঢ় বঙ্গ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাংশেও মতুয়াদের প্রভাব রয়েছে। মহুয়ার কৃষ্ণনগরেও মতুয়া ভোটার উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের পাঁচ আসনেও মতুয়া ভোটার আছে। এ অবস্থায় আগামী বছরের নির্বাচনের আগে মহুয়ার ‘বেফাঁস’ মন্তব্যকে হাতিয়ার করে তৃণমূলকে নিশানা করতে ছাড়ছেন না শান্তনু। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, “মহুয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন, মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ তৃণমূলের সঙ্গে নেই৷ তার কারণ, ওদের (তৃণমূলের) এই ঔদ্ধত্য৷ এর জন্য তৃণমূলের সঙ্গে মতুয়ারা নেই৷ ৮৫-৯০ শতাংশ মতুয়া বিজেপিকে ভোট দেন এবং আগামীতেও দেবেন। মমতাবালা ঠাকুরের পক্ষের মতুয়া বলে কোনও কিছু নেই৷ মতুয়া সম্প্রদায়কে অপমান করা মানে মতুয়াদের গায়ে লাগা৷”
অন্য দিকে মমতাবালার অনুগামী হিসেবে পরিচিত মতুয়া সমাজের এক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুকেশ চৌধুরীর কথাতেও প্রায় শান্তনুরই সুর। ভাতা যে সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়, কারও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়— তা মনে করিয়ে দিয়েছেন সুকেশও। তিনি বলেছেন, “কারও ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভাতা নয়, এটা সরকারি প্রকল্প৷ ভাতা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে পান।” মতুয়াদের নিয়ে মহুয়া মৈত্র মন্তব্যের সমালোচনা করে সুকেশ বলেন, “এই ধরনের মন্তব্যের জন্য মহুয়া মৈত্রকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে৷ তিনি ক্ষমা না-চাইলে, আগামী দিনে মতুয়ারা বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে৷” বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জানানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
যদিও তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ তথা মমতাবালা নিজে মহুয়া প্রসঙ্গে মুখ খোলেননি। কিন্তু তাঁর অনুগামীরা যে ভাবে মহুয়ার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন এবং ‘বিকল্প সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা মমতাবালার নির্দেশেই হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। গত বেশ কিছু বছর ধরেই কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের পরিবার এবং মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের পরিবারের মধ্যে ফাটল চওড়া হচ্ছিল। কপিলকৃষ্ণের প্রয়াণের পরে সে বিবাদ আরও বৃদ্ধি পায়। মঞ্জুলকৃষ্ণ এবং তাঁর দুই ছেলে সুব্রত ও শান্তনুর হাতেই ঠাকুরবাড়ির মূল নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। কিন্তু, সম্প্রতি সুব্রত-শান্তনুর বিবাদ প্রকাশ্যে এসেছিল। সে বিবাদে আবার কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী মমতাবালা ও মঞ্জুলকৃষ্ণের বড় ছেলে সুব্রত এক হয়ে গিয়েছিলেন শান্তনু এবং মঞ্জুলকৃষ্ণের বিরুদ্ধে। তাতে বিজেপির অস্বস্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তার পরে মহুয়ার এমন মন্তব্য তৃণমূলকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিল বলে মনে করা হচ্ছে। তৃণমূল সাংসদ মমতাবালার অনুগামীরাও মহুয়ার বিরুদ্ধে মুখ খোলায় সেই অস্বস্তি আরও প্রকট হল।