সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার বার্তা ইঁদে

ইন্দ্রাভিষেক বা ইন্দ্র পুজোটি স্থানীয়দের উচ্চারণগত অপভ্রংশে পরবর্তী কালে ‘ইঁদ পরব’ হয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে পরবের চেহারা-চরিত্র। শরতের আগমনে আকাশে সাদা মেঘ। খেতে বেড়ে উঠছে সবুজ ধান। নদীর পাড়ে ও মাঠে গুচ্ছ কাশফুল। রাজপ্রাসাদের বাইরে উঁচু একটি মঞ্চে বসে রয়েছেন গড় ঝাড়গ্রামের অধীশ্বর।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১০:৫৫
Share:

শরতের আগমনে আকাশে সাদা মেঘ। খেতে বেড়ে উঠছে সবুজ ধান। নদীর পাড়ে ও মাঠে গুচ্ছ কাশফুল। রাজপ্রাসাদের বাইরে উঁচু একটি মঞ্চে বসে রয়েছেন গড় ঝাড়গ্রামের অধীশ্বর। মল্লদেব রাজবংশের রাজার মাথায় পাগড়ি। হাতে রাজদণ্ড। বিশেষ দিনটিতে করদ রাজা ও প্রজারা হাজির রাজদর্শনে। কয়েকশো বছর আগে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে এমনই বার্ষিক অনুষ্ঠান হত গড়-ঝাড়গ্রামে।

Advertisement

জনশ্রুতি, ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজ বংশের আদিপুরুষ সর্বেশ্বর সিংহের রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশে ইঁদ পরবের সূচনা হয়েছিল। ওই দিনে ইন্দ্ররূপী একটি গাছের গুঁড়িকে দড়ি দিয়ে রাজা ও প্রজারা টেনে তুলতেন। রাজাও হয়ে উঠতেন সর্বসাধারণের একজন। ফসলের সমৃদ্ধি কামনায় ওই বিশেষ দিনে ইন্দ্রপুজোর আয়োজন করা হত। ইন্দ্রাভিষেক বা ইন্দ্র পুজোটি স্থানীয়দের উচ্চারণগত অপভ্রংশে পরবর্তীকালে ‘ইঁদ পরব’ হয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে পরবের চেহারা-চরিত্র। এখনও প্রতিবছর ঝাড়গ্রাম-সহ জঙ্গলমহলের নানা প্রান্তে ইঁদ পালিত হয়। অনুষ্ঠানটিই বৃক্ষ-কেন্দ্রিক।

এই পরবে ছাল-বাকল ছাড়ানো আস্ত একটি শাল গাছের গুঁড়ি লাগে। ওই শাল বল্লিকেই ইন্দ্ররূপে পুজো করা হয়। জনশ্রুতি, প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে গড় ঝাড়গ্রামের স্থানীয় জংলি মাল রাজাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করে রাজ্যপাট দখল করেছিলেন রাজপুতানার সর্বেশ্বর সিংহ। তিনিই ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজ বংশের আদিপুরুষ। সর্বেশ্বরের রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই এই উত্সবের সূচনা হয়। লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে, “রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানটিতে পরবর্তীকালে ইন্দ্রের দেবত্ব আরোপিত হয়ে ‘ইন্দ্রাভিষেক’ হয়েছে। আগে ঝাড়গ্রামে ইঁদের বড় মেলা হত। এখন অবশ্য মেলা হয় না। গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন এলাকায় এখনও হাতেগোনা কয়েকটি ইঁদের মেলা হয়।”

Advertisement

পরবের প্রক্রিয়া শুরু হয় দিন চারেক আগে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের রাধাষ্টমী তিথিতে। ওই দিন বন দফতরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে একটি শালগাছের আস্ত গুঁড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয় ঝাড়গ্রাম শহরের পুরনো ঝাড়গ্রামের ইঁদকুড়ি ময়দানে। তারপর প্রথা অনুযায়ী, শাল গাছের গুঁড়িটির ছালবাকল চেঁছে লম্বা ও মোটা শালবল্লিটি তৈরি করা হয়। সেটিকে বলা হয় ‘ইঁদকাঠ’। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের পার্শ্ব একাদশীর দিনে শালবল্লিটিকে অর্ধেকটা তুলে হেলিয়ে কৌণিক ভাবে রাখা হয়। এটিকে বলা হয় ‘আধাগাছি’। আজ মঙ্গলবার, দ্বাদশী তিথির গভীর রাতে ইন্দ্রপুজোর পরে হেলিয়ে রাখা বল্লিটি দড়ি ধরে টেনে সোজা করে তোলা হবে। দড়িতে প্রথম টান দেবেন মল্লদেব রাজ পরিবারের উত্তরসূরি। তারপর দড়িতে টান দেবেন ব্রাহ্মণ পূজারি। সবশেষে পরাজিত মাল রাজার এক উত্তরসূরি এবং সর্বসাধারণ দড়ি ধরে টান দিয়ে ‘ইঁদকাঠ’টি তুলবেন। ইঁদকাঠ তোলার রাতে ঝুমুর ও লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান হয়। সাত দিন পরে স্থানীয় সাবিত্রী পুকুরে ‘ইঁদকাঠ’ বিসর্জন দেওয়া হয়। ইঁদপুজোর দিনে ভাল ফসলের আকাঙ্ক্ষায় মূলবাসীরা ইন্দ্রদেবের সন্তুষ্টির জন্য ধানজমিতে ‘পড়াশি ঝাঁটি’ নামে এক ধরনের গাছের ডাল পোঁতেন। কেউ কেউ আবার শাল গাছের ডালও পোঁতেন। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘ডালগাড়া’। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইঁদকাঠটি তোলার এই অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলার বার্তা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন