প্রশ্নের মুখে ইসিএসসি

সহায়ক মূল্যের চেক বাউন্স, বিপাকে চাষিরা

চাষিদের সাহায্য করতে সহায়ক মূল্যে ধান কিনেছিল সরকার। দাম পাওয়ার কথা ছিল চেকে। কিন্তু সেই সরকারি চেকও ‘বাউন্স’ হয়ে যাচ্ছে। মাসুল গুনতে হচ্ছে কৃষককে। কাঠগড়ায় সরকারি সংস্থা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগম (ইসিএসসি)। চলতি আর্থিক বছরে একের পর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। ধানের দাম পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত উত্‌পাদনের জেরে আলুও বিকোচ্ছে জলের দরে। ঢাকঢোল পিটিয়ে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার কথা ঘোষণা করে সরকার কার্যত ব্যর্থ। যে কয়েক ছটাক ধান সহায়ক মূল্যে কেনা হয়েছে তারও দামটুকু পেতেও কালঘাম ছুটে যাচ্ছে চাষিদের।

Advertisement

সুমন ঘোষ

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০২:০৫
Share:

চাষিদের সাহায্য করতে সহায়ক মূল্যে ধান কিনেছিল সরকার। দাম পাওয়ার কথা ছিল চেকে। কিন্তু সেই সরকারি চেকও ‘বাউন্স’ হয়ে যাচ্ছে। মাসুল গুনতে হচ্ছে কৃষককে। কাঠগড়ায় সরকারি সংস্থা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগম (ইসিএসসি)।

Advertisement

চলতি আর্থিক বছরে একের পর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। ধানের দাম পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত উত্‌পাদনের জেরে আলুও বিকোচ্ছে জলের দরে। ঢাকঢোল পিটিয়ে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার কথা ঘোষণা করে সরকার কার্যত ব্যর্থ। যে কয়েক ছটাক ধান সহায়ক মূল্যে কেনা হয়েছে তারও দামটুকু পেতেও কালঘাম ছুটে যাচ্ছে চাষিদের।

শালবনির সাতপাটির বাসিন্দা পলাশ বেতাল বলেন, “আমি সামান্য বেশি লাভের আশায়, সরকারকে ৩৩ কুইন্টাল ধান বিক্রি করেছিলাম। সরকার ৪৪ হাজার ৮৮০ টাকার চেকও দিয়েছিল। টাকা জমা হয়নি উল্টে আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে দু’বারে ২০৪ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।’’ মেদিনীপুর সদর ব্লকের জামতলার বাসিন্দা শেখ এরশাদ আলিরও একই অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘‘৩০ কুইন্টাল ২৫ কেজি ধান বিক্রি করে ৪১ হাজার ১৪০ টাকার চেক পেয়েছিলাম। কিন্তু টাকা পাইনি, উল্টে আমার জমা টাকা থেকে ৮০ টাকা কেটে নিয়েছে ব্যাঙ্ক। জানতে চাইলে ব্যাঙ্ক বলেছে ‘চেক বাউন্স’ হলে আমাদের কিছু করার নেই। টাকা কাটবেই।’’

Advertisement

শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই প্রায় ৯০০ জন চাষির ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। বীরভূম, বাঁকুড়া, হুগলি-সহ চারটি জেলা মিলিয়ে এমন চাষির সংখ্যা কয়েক বাজার হবে বলেই অনুমান। চাষিদের দাবি, প্রায় ২০ দিন হতে চলল টাকা মিলছে না। এমনিতে ধানের সহায়ক মূল্য মেলেনি, কম দামে খোলাবাজারে বেশির ভাগ ধান বিক্রি করে ক্ষতি হয়েছে। আলু চাষ করেও চুড়ান্ত ক্ষতি হয়েছে। তার উপর সহায়ক মূল্যে যেটুকু ধান বেচেছিলেন, তারও যদি টাকা না পাওয়া যায় তাহলে কী হবে! তাঁদের আশঙ্কা আবারও এমনটাই হতে পারে।

কিন্তু ঠিক কেন ‘বাউন্স’ করে যাচ্ছে সরকারি চেক? এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা খাদ্য নিয়ামক পার্থপ্রতিম রায়। জেলা খাদ্য ও সরবরাহ দফতর জানিয়ে দিয়েছে, এ ব্যাপারে যা বলার ইসিএসসি বলবে।

ঠিক কী হয়েছিল?

চলতি বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকে চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লক্ষ ৬২ হাজার টন। সহায়ক মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে (কুইন্টাল প্রতি ১৩৪০ টাকা) রাইস মিলে চাল বানিয়ে তা নেওয়ার কথা। জেলা খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা ইসিএসসি, বেনফেড, কনফেড-সহ বিভিন্ন সংস্থার এই কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু আর্থিক বছর শেষ হয়ে গেলেও চাল সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। প্রশাসনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ লক্ষ ৬১ হাজার মেট্রিক টনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৪৯ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন চাল কেনা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই চাষিদের খোলাবাজারে কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। সহায়ক মূল্যে যেখানে কুইন্টাল প্রতি ধানের দাম ১৩৬০ টাকা সেখানে খোলাবাজারে দাম ১০৫০ টাকার বেশি ওঠেনি।

ফেব্রুয়ারি মাসে ইসিএসসি জেলার ২০টি জায়গায় শিবির করে ধান কেনা শুরু করায় খোলাবাজারে ধানের দাম কিছুটা বেড়ে কুইন্টাল প্রতি ১১০০ টাকা হয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাসের ৯ তারিখের পর থেকে বের ধান কেনা বন্ধ করে দেয় ইসিএসসি। ফলে ধানের দাম ফের পড়তে শুরু করে। এই সময়ে ইসিএসসি যে ধান কিনেছিল তারই দাম মিলছে না বলে অভিযোগ। জেলায় ইসিএসসির চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৬১ হাজার মেট্রিক টন সেখানে মাত্র ১৭ হাজার মেট্রিক টন চাল কিনেই কেন শিবির বন্ধ করে দেওয়া হল? কেনই বা চাষিদের চেক বাউন্স হয়ে যাচ্ছে?

ইসিএসসি সূত্রে জানা গিয়েছে, শিবির চলাকালীন যে ধান কেনা হয়েছে তা সঠিক চাষিদের কাছ থেকে কেনা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। বিশেষত, ৪ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত যে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছিল, তা চাষিরা নয় ফোড়েরা বিক্রি করেছিল বলে অভিযোগ। এখন তারই তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হলে টাকা দেওয়া হবে না।

তবে এ বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ধান কেনার জন্য রাইস মিলের কাছে শিবির করা হয়েছিল। যাতে দ্রুত চাল তৈরির জন্য তা রাইস মিলে পৌঁছে দেওয়া যায়। সেখানে ধান কেনার সময় চাষির সঠিক পরিচয়পত্র দেখেই ধান কেনা হয়েছিল। দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সংস্থার ‘পারচেজ অফিসার’। জেলা খাদ্য সরবরাহ দফতরের আধিকারিকেরাও সহযোগিতা করেছেন। তাছাড়াও কিষান ক্রেডিট কার্ড-সহ একাধিক নথি দেখেই চেক লেখা হয়েছিল, যাতে চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেই টাকা জমা পড়ে। তা সত্ত্বেও গরমিল হল কিভাবে? আর যদি গরমিল হয়েই থাকে, তা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের শাস্তি হল না কেন?

উত্তর মেলেনি। মন্তব্য করতে চাননি খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও।

ক্ষুব্ধ চাষিরা দাবি করেছেন ব্যাঙ্কের কেটে নেওয়া টাকার পাশাপাশি ধানের দাম অবিলম্বে মিটিয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে একটি সরকারি সংস্থায় এমন ঘটনা ঘটল কী করে তারও তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন