প্রতীকী ছবি।
দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন কারও জন্ম হয়নি, কেউ আবার দশেরও গন্ডি পেরোননি। অথচ সরকারি খাতায় এঁরা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’। সেই মতো পেয়ে আসছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাপ্য পেনশন থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। সম্প্রতি সেই ভুয়ো পরিচয় ধরা পড়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে ওই ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’দের পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা। তথ্য জানার অধিকার আইনের সহায়তায় এমন ঘটনা সামনে আসায় নড়ে চড়ে বসেছে রাজ্য প্রশাসন থেকে কেন্দ্রের সরকার।
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে এমনই ৬ জনের খোঁজ মেলায় তাঁদের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের তরফে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এঁদের মধ্যে ননীগোপাল সামন্ত, কানাই লাল মাইতি, রাজবালা মাইতি অমৃতবেড়িয়ার বাসিন্দা। অনন্ত পাল কেশবপুরের এবং তারাপদ তিওয়ারি ও শোভারানি মাল গড় কমলপুরের বাসিন্দা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ব্লকের বাসিন্দা তপন কুমার জানা ‘তথ্য জানার অধিকার’ আইনে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবেদন জানিয়েছিলেন। তারপরই এই ৬ জনের সম্পর্কে উঠে আসে এমন তথ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন অনুযায়ী, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে শহিদ বা ছ’মাস জেলবন্দি বা আত্মগোপন করে ছিলেন (পুরস্কার ঘোষিত) এমন কেউ পেতে পারেন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে ‘স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মান’ (এসএসএস)। ব্রিটিশ পুলিশের লাঠিতে জখম হওয়ার বা গুলি খাওয়ার প্রমাণ দেখাতে পারলেও মেলে এই সম্মান। কিন্তু মহিষাদলের এঁদের ক্ষেত্রে কোনও নিয়মই মানা হয়নি বলে অভিযোগ। এই ৬ জনের মধ্যে চারজন ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। জীবিত আছেন তারাপদ তিওয়ারি, শোভারানি মাল।
স্থানীয় সূত্রে খবর, শোভারানি দেবীর স্বামী শ্রীদাম মাল স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে মারা যাওয়ার পর পেনশন পেতেন তিনি। তারাপদ তিওয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে যে তথ্য জমা দিয়েছিলেন, তাতে উল্লেখ রয়েছে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ‘ভারত ছাড় আন্দোলনে’ তিনি কারাবাস করেছিলেন। কিন্তু জানা গিয়েছে, সেই সময় মহিষাদলের একটি প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। তখন বয়স ছিল ৯ বছর ৬ মাস। ননীগোপাল সামন্ত সম্পর্কে জানা গিয়েছে, ভোটার তালিকা হিসাবে ১৯৭৫ সালে তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫। এঁরা সকলেই পেনশন হিসেবে কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রায় সতেরো হাজার এবং রাজ্য সরকারের দেওয়া হাজার সাতেক টাকা পেতেন। একইসঙ্গে বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস, টেলিফোন যোগাযোগ, এসি ট্রেনে দেশ ভ্রমণের মতো একাধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ‘পলিটিক্যাল সাফারার্স পেনশন’ বন্ধ করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর এই ‘ভুয়ো’ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিষয় প্রকাশ্যে আসতেই তদন্তে নামে সিআইডি। ২০১২ সালের ৪ এপ্রলি থেকে এঁদের ব্যাঙ্ক আক্যাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহিষাদল থানায় এদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন। কিন্তু অভিযুক্তদের ধরতে গিয়ে ফাঁপরে পড়ে পুলিশ। দেখা যায় এদের অনেকেই মারা গিয়েছেন। বাকিরা বেঁচে থাকলেও তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন পুলিশের দাবি।
এই ব্যাপারে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাস্ট্র দফতরের এক কর্তা দীপক মিত্র বলেন, ‘‘দীর্ঘদিনের পুরনো মামলা। তা ছাড়া কলকাতা থেকে ওই দফতর দিল্লিতে চলে এসেছে। পুরনো নথিপত্র না দেখে কিছু বলা মুশকিল।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলার পুলিশ সুপার ভি সলোমন নেসাকুমার বলেন, ‘‘মামলাটি বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে জানি না। এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বলতে পারব।’’
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এমন ঘটনা সামনে আসায় বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীই ক্ষুব্ধ। তাঁদের একজনের কথায়, ‘‘যারা বহু কষ্টে পাওয়া স্বাধীনতাকে এ ভাবে কলুষিত করে তাদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত।’’