তিন বছরেও কাজ এগোয়নি। এই সময়ের মধ্যে প্রশাসন ‘ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর প্রাথমিক কাজটুকুও শেষ হয়নি পশ্চিম মেদিনীপুরে। ফলে মেলেনি দ্বিতীয় কিস্তির টাকাও।
সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, ৫ বছরের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে প্রকল্প রূপায়ণের কাজ শেষ করার কথা। প্রকল্পটি রূপায়িত হলে এক একটি জলবিভাজিকা এলাকার একাধিক গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। তা সত্ত্বেও কেন কাজটি করা যায়নি? এ নিয়ে অবশ্য সদুত্তর মেলেনি প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে। কৃষি ও ভূমি সংরক্ষণ দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর (প্রশাসন) সুকুমার কিস্কুর কথায়, “প্রকল্পগুলি ২০১১-১২ আর্থিক বছরে শুরু হলেও প্রথম ধাপের টাকা পেতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। ফলে কাজে গতি কিছুটা কম।” জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারির কথায়, “কী কারণে কাজ এগোয়নি তা খতিয়ে দেখা হবে। কাজে গতি আনতে নিয়মিত কাজের পর্যালোচনাও করতে বলা হয়েছে।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা মোট ২১টি বৃহত্ জলবিভাজিকা প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছিল। তার মধ্যে ২০১১-১২ আর্থিক বছরে ১৬টি ও ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ৫টি প্রকল্প ছিল। এর মধ্যে ১৬টি প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯৭ কোটি টাকা ও ৫টি-র জন্য প্রায় ৩৪ কোটি টাকাও মঞ্জুরও করা হয়। যার মধ্যে প্রথম ধাপের কাজের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকাও পেয়ে গিয়েছে জেলা। তার মধ্যে ২ কোটির টাকার কাছাকাছি অর্থ খরচ করা গিয়েছে। ওই ২ কোটি টাকায় মূলত কোনও এলাকায় প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিকাঠামো তৈরি করার কথা ছিল। যেমন, কোথাও রাস্তা খারাপ হলে তা সারিয়ে দেওয়া, কালভার্ট ভেঙে পড়লে সংস্কার করা বা নতুন করে দেওয়া, পানীয় জলের সঙ্কট থাকলে ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই কাজও সম্পূর্ণ করতে পারেনি প্রশাসন।
কোনও একটি এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই ধরনের প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে বৃহত্ প্রকল্পের মধ্যে একাধিক ছোট্ট ছোট্ট জলবিভাজিকা রয়েছে। ন্যূনতম ১৯টি মৌজা থেকে শুরু করে ৯৬টি পর্যন্ত মৌজা উপকৃত হওয়ার কথা। যেখানে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার হেক্টর পর্যন্ত জমি রয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য কী? একটি বৃহত্ জল বিভাজিকার আওতায় ন্যূনতম ১৮টি থেকে ৪২টি গ্রাম রয়েছে। প্রথমেই দেখতে হবে ওই গ্রামের জনসংখ্যা কত। তাঁদের মধ্যে কারা কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত। অর্থাত্ কৃষিকাজ করেন না মত্স্যচাষ। প্রাণিপালন করেন না ঝুড়ি তৈরি করেন। এ ক্ষেত্রে দেখা হবে, যাঁরা চাষ করেন তাঁদের সেচের সুবিধে রয়েছে কি না। তা দেখার পর স্থানীয় স্ব-সহায়ক দলের মাধ্যমে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেখা হবে, কতজন কী কাজ করতে আগ্রহী। এই সব সমীক্ষার জন্য কর্মীও নিয়োগ করা হবে। স্ব-সহায়ক দল কী ভাবে পরিকল্পনা নেবে, কী ভাবে প্রকল্প রূপায়িত করবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, স্ব-সহায়ক দলের মাধ্যমেই এই কাজ করার কথা। তাঁদের তৈরি করা কমিটিকে সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইন মেনে নথিভুক্তও করতে হবে। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হবে। তারপর সেচের জন্য পুকুর কাটতে চাইলে পুকুর কাটা হবে, মাছ চাষ করতে চাইলে চাষ করার ব্যবস্থা করা হবে, উন্নত ধরনের ফসল চাষ করানো হবে। তাছাড়া ঝুড়ি, শালপাতার থালা তৈরির জন্য উদ্যোগী হলে সে ব্যাপারেও সাহায্য করা হবে। এমনকী কোনও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ঋণ চাইলে প্রশাসন এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করে ঋণও পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
তিন বছর আগে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ওই প্রকল্পগুলির কয়েকটিতে কেবলমাত্র ‘এন্ট্রি পয়েন্ট অ্যাকটিভিটি’ অর্থাত্ গ্রামে মূল প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে যে রাস্তা সারাই, কালভার্ট তৈরি বা অন্য সামান্য কাজ রয়েছে সেটুকুও সব ক্ষেত্রে করে ওঠা যায়নি। এমনকী স্ব-সহায়ক দলগুলিকে নিয়ে তৈরি করা সোসাইটির রেজিস্ট্রেশনও করাতে পারেনি। সবেমাত্র কয়েকটি সোসাইটি তৈরি করে তা রেজিস্ট্রেশনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে এমনও ঘটছে যে, আগে যে সব জলবিভাজিকা প্রকল্পে উন্নয়নের কাজ হয়েছিল তারও কয়েকটিকে এই বৃহত্ প্রকল্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। গড়বেতা ২ ব্লকের ডুমুরিয়া, ইন্দকুড়ি-সহ কয়েকটি ক্ষেত্রে এমন ঘটনাও ঘটেছে। ফলে নতুন এলাকাগুলি উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এই কাজে এত ঢিলেমি? কেনই বা একই জল বিভাজিকা একাধিক প্রকল্পে ঢুকে যাচ্ছে? প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত প্রশাসনিক কর্তাদের উদাসীনতাই এর প্রধান কারণ। ফলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আদৌ কাজ সম্পূর্ণ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে, ওই প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
প্রশাসন অবশ্য এ বার কাজে গতি আনার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অবশ্য সংশয় থেকেই যাচ্ছে।