বেলদায় বাড়ছে বসতি, বালাই নেই পরিষেবার

রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে যানবাহন। দু’দিকে বিরাট বিরাট দোকান। তারই ফাঁকে ছোট্ট কোণে গজিয়ে উঠেছে পানের গুমটি, চা দোকান। এত দ্রুত লয়ে যে একটি গ্রামের চেহারা এভাবে বদলে যেতে পারে তা কে বলবে। বেলদা এখন পুরোদস্তুর শহর। যা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অনেক পুর এলাকাকেও হার মানিয়ে দেবে। মূলত, ব্যবসার কারণেই বেলদার এই বাড়বাড়ন্ত।

Advertisement

সুমন ঘোষ

বেলদা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:২১
Share:

বেলদার অপরিসর রাস্তায় যানজটের এই চিত্র নিত্যদিনের (বাঁ দিকে), সংস্কারের অভাবে অবরুদ্ধ মহানালা (ডান দিকে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে যানবাহন। দু’দিকে বিরাট বিরাট দোকান। তারই ফাঁকে ছোট্ট কোণে গজিয়ে উঠেছে পানের গুমটি, চা দোকান। এত দ্রুত লয়ে যে একটি গ্রামের চেহারা এভাবে বদলে যেতে পারে তা কে বলবে। বেলদা এখন পুরোদস্তুর শহর। যা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অনেক পুর এলাকাকেও হার মানিয়ে দেবে। মূলত, ব্যবসার কারণেই বেলদার এই বাড়বাড়ন্ত। আর এই কারণেই বেলদাকে পুরসভা করার দাবিও উঠেছিল অনেক আগে থেকেই। এ বার সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

Advertisement

বেলদার জন্মের ইতিহাস এক রূপকথা। মুগবেড়িয়ার জমিদার ছিলেন গঙ্গারাম নন্দ। তাঁর দাদা দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিধি একবার পুরী যাচ্ছিলেন। তখন বেঙ্গল নাগপুর রেলের সৌজন্যে বেলদার উপর দিয়েই রেলপথ গিয়েছিল। ওই বৃদ্ধা থাকতেন একটি ঝুপড়িতে। তাঁর ছিল ছোট্ট একটি দোকান আর দোকানের সামনে পুুকুর। তাঁর দোকান থেকে বাতাসা কিনে দূর থেকে আসা মানুষ পুকুরের জল খেতেন। দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিধিও পুরী যাওয়ার পথে বেলদা যখন পৌঁছান তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। আহ্নিক করার জন্য পুকুর থেকে জল নিচ্ছিলেন বৃদ্ধার বিনা অনুমতিতে। বৃদ্ধা তীব্র বেগে প্রশ্ন ছোঁড়েন, কে জল নিচ্ছে? দিগম্বর নন্দ উত্তর দেন, ‘আমি মুগবেড়িয়ার জমিদার দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিধি।’ আর তখনই বৃদ্ধার মুখ থেকে ঝরে পড়ে সেই পরিহাস, “আচ্ছা জমিদার হে, যাকে লোকের পুকুরে জল নিতে হয়। এতই যদি জমিদার তো একটা পুকুর কেটে দেখাও না!”

জমিদারপুত্রের মনে কথাটা দাগা দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরী যাওয়া বাতিল করে বাড়ি ফেরেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ভাই গঙ্গাধর নন্দকে জানান, বেলদাতে পুকুর খনন করার কথা। গঙ্গাধর নন্দ শুধু পুকুর খনন (যার নাম চাঁদনি ঘাট) করেছিলেন তা-ই নয়, একটি ধর্মশালাও তৈরি করেছিলেন। যাতে পুরী যাওয়ার পথে মানুষ বিশ্রামের একটা জায়গা পান। তারই পাশাপাশি বেলদাতে বসতি গড়ার জন্য পুত্র বিরাজচরণ নন্দকে নির্দেশ দেন। বাবার নির্দেশ মতো ২২ বছর ধরে বেলদায় থেকে বসতি স্থাপন করার কাজ করেন বিরজাচরণ নন্দ। ময়না কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সংস্কৃতের শিক্ষক তথা নন্দ বংশের বংশধর ব্রহ্মময় নন্দ বলেন, “এ ভাবেই বেলদার পত্তন করেছিলেন গঙ্গাধর নন্দ।” ওই বংশেরই উত্তরসূরি চৈতন্যময় নন্দ বলেন, “বসতি স্থাপনের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে দীর্ঘদিন বেলদাতে নিজের জীবন কাটিয়েছিলেন বিরজাচরণ নন্দ।”

Advertisement

কী করেননি তিনি! গড়েছিলেন স্কুল। বর্তমানে যার নাম বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমি। গড়েছিলেন বাজার। সেই নন্দ মার্কেট এখনও রয়েছে। বর্তমান যুব সমাজের কাছে অবশ্য বেলদার এই ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই অজানা থেকে গিয়েছে। প্রাচীনত্বের পাশাপাশি বর্তমানে বসতি এলাকা এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে বেলদার গুরুত্ব অপরিসীম। জৈন, মাড়োয়ারি, গুজরাতি-সহ বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ এখানে বসবাস করেন। ব্যবসার সৌজন্যেই প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে জনসংখ্যা। তাছাড়াও একটি বালিকা বিদ্যালয়-সহ রয়েছে তিনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুল। রয়েছে সাধারণ কলেজ। বেসিক ট্রেনিং কলেজ, হাসপাতাল। ফলে সকলেই এখানে থাকতে চাইছেন।

আর এই বসতির চাপে বেসামাল হয়ে উঠছে গ্রাম থেকে বিবর্তনের পথে গজিয়ে ওঠা এই ছোট্ট শহর। কারণ, এই শহরকে দেখভাল করার মতো প্রশাসক কোথায়? পঞ্চায়েত এলাকা হওয়ায় পুরসভার মতো নজরদারি নেই। ফলে অপরিকল্পতি ভাবে গড়ে ওঠা শহরের এখন থেকেই নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। নেই সর্বত্র নিকাশি ব্যবস্থা, নলবাহিত পানীয় জল বা রাস্তার আলো। একটি বড় নিকাশি খাল রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে আবর্জনার স্তূপ পড়ে তা মজে গিয়েছে। রাস্তাও সর্বত্রই সঙ্কুচিত। চাষের জমি কিনে তা বাস্তু জমিতে পরিণত করে বাড়ি তৈরি করে নিয়েছেন সকলেই। তারপর নিজেদের মর্জি মতো দু’চার ফুট রাস্তা ছেড়ে বাড়ি করে ফেলেছেন। বসতি বাড়লে রাস্তার ধারে দু’দিকে নিকাশি নালা করতে হবে। তখন সাকুল্যে ২-৩ ফুট ছাড়া রাস্তা থাকবে না। তাতে বড় জোর একটি মোটরবাইক যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ কোথাও আগুন লাগলে, দমকল ঢুকবে কী ভাবে? কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্যান্সই বা যাবে

কোন পথে?

শুধু এটাই কেন? চাষের জমি থাকায় তা তো উঁচু-নীচু থাকবেই। আগে যারা বাড়ি করেছিলেন তাঁরা নীচু অবস্থাতেই বাড়ি করেছেন। এখন যাঁরা নতুন বাড়ি করছেন তাঁরা জমি ভরাট করে কিছুটা উঁচু থেকে মেঝে শুরু করছেন। সেই জায়গায় রাস্তা করাও সমস্যার। আবার বর্তমানের উঁচু মেঝের নিরিখে রাস্তা বানাতে হলে আগের তৈরি বাড়ির মেঝেতে জল ঢুকে যাবে অনায়াসে। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজু চাণ্ডকের কথায়, “এ রকম ভুরি ভুরি সমস্যা থেকে গিয়েছে। যা ভবিষ্যতে দিনে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে বলেই আমাদের আশঙ্কা। তাই আমরা সব সময় এ ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি।” বেলদা পঞ্চায়েতের (৮/২) প্রধান সুলেখা দে বলেন, “রাস্তা, পানীয় জল সরবরাহের উন্নয়নে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে এত বড় শহরকে দেখার মতো পরিকাঠামো না থাকায় সমস্যা হয়।” বেলদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সনাতন মঙ্গল বলেন, “আমরা কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনার বিষয়ে নজর রাখছি। তবে এতগুলো পঞ্চায়েতের কাজের দেখভাল করে শহরকে বিশেষভাবে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে আশা করছি, বেলদা পুরসভা হলে উন্নয়নের প্রসার হবে।”

এই চেষ্টাটা যে সার্বিক ভাবে হওয়া উচিত তা স্বীকার করছেন সকলেই। নতুবা কিছুদিনের মধ্যেই সাধের শহর শহরবাসীর কাছেই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াবে যে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন