জেলায় জেলায় সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটের (এসএনসিইউ) দৌলতে রাজ্যে শিশুমৃত্যু এক ধাক্কায় অনেকটা কমেছে। অথচ এসএনসিইউ থেকে ছাড়া পাওয়া অনেক বাচ্চা ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। যার জন্য আঙুল উঠছে নজরদারি, পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোয় ঘাটতির দিকে।
চিকিৎসা পরিভাষায় সমস্যাটিকে বলা হয় রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিওরিটি, সংক্ষেপে আরওপি। কারণ হিসেবে মূলত এসএনসিইউয়ে ব্যবহৃত জীবনদায়ী অক্সিজেনকে দায়ী করে থাকেন ডাক্তারদের অনেকে। এতে নবজাতকের চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে যায়।
এবং চিকিৎসকদের বড় অশের অনুযোগ, গত ক’বছরে এসএনসিইউয়ের সংখ্যা বাড়াতে সরকার যতটা তৎপর, শিশুদের পরবর্তী দেখভালের ব্যাপারে ততটা চাড় দেখা যাচ্ছে না। ঠিকঠাক নজরদারিতে বিপদ অনেকটা এড়ানো যায় বলে ওঁদের দাবি। কী রকম?
চিকিৎসকেরা বলছেন, কোনও সদ্যোজাতকে একশো ভাগ অক্সিজেন সহায়তায় রাখা হলে পরে তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে। দৃষ্টি হারানোর ভয়ই বেশি। তাই এসএনসিইউয়ের বাচ্চাদের উপরে পরবর্তী চার সপ্তাহের মধ্যে নজর শুরু হওয়া জরুরি। তাতে ধরা পড়বে, চোখের কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, বা হলে কতটা। আরওপি ধরা পড়লে চিকিৎসা দরকার। মূল চিকিৎসা—লেসার থেরাপি।
ঘটনা হল, লেসার থেরাপির উপযুক্ত পরিকাঠামো এখনও রাজ্যে গড়ে ওঠেনি। সচেতনতাতেও ঘাটতি। অভিযোগ, ডাক্তারদের বড় অংশের মধ্যেও তা প্রকট। ছুটি দেওয়ার সময়ে বাড়ির লোককে ওঁরা বলে দেন না যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাচ্চাকে ফের হাসপাতালে এনে চোখ দেখাতে হবে। অনেক সময়ে ডাক্তারবাবু বলে দিলেও মা-বাবা মুশকিলে পড়েন, কারণ জেলায় অনেক সরকারি হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ নেই। থাকলেও লেসার থেরাপি হয় না।
অগত্যা অগতির গতি সেই কলকাতা। কিন্তু মহানগরেও হাতে গোনা জায়গায় তার বন্দোবস্ত।
পরিণামে সঙ্কট দিন দিন গভীর হচ্ছে। চক্ষু চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যে কোনও চোখের ডাক্তার আরওপি স্ক্রিনিং করতে পারেন না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, আলাদা পরিকাঠামো দরকার।’’ চক্ষু চিকিৎসক অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানান, আরওপি’র বিভিন্ন স্টেজ রয়েছে। জন্মের চার সপ্তাহের মধ্যে স্ক্রিনিং সবচেয়ে জরুরি। তা হলে চিকিৎসায় ভাল সাড়া মেলে।
আরওপি
রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিওরিটি
• শিশু ৩৪ সপ্তাহের আগে জন্ম নিলে
• ওজন ১৭৫০ গ্রাম বা তার কম হলে
• জন্মের পরে ১০০% অক্সিজেন সহায়তায় থাকা
• সংক্রমণ, মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন, রক্তাল্পতা
• একাধিক বার রক্ত দেওয়া
বিপদ
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্তরে আরওপি চিকিৎসা হয়ে থাকে রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি এবং এসএসকেএমে। যদিও স্বাস্থ্য প্রশাসনের ইঙ্গিত, চাহিদার দশ ভাগ পরিষেবাও দেওয়া যাচ্ছে না। ‘‘প্রচুর বাচ্চা আরওপি নিয়ে সরকারি হাসপাতালে আসে। ডাক্তারদের ট্রেনিং না-থাকায় কিছু করার থাকে না। বারবার বলেও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি।’’— আক্ষেপ করছেন ন্যাশনাল মেডিক্যালের চক্ষু বিভাগের প্রাক্তন প্রধান জ্যোতির্ময় দত্ত। স্বাস্থ্যভবন কী বলে?
চক্ষু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত স্বাস্থ্য-অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী কবুল করছেন, রাজ্যে সামগ্রিক ভাবে ওই পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আরওপি স্ক্রিনিং খুব সুক্ষ্ম কাজ। স্পেশ্যাল ট্রেনিং দরকার। বহু জায়গায় তা করা যায়নি। খানিকটা সময় লাগবে।’’ এ বিষয়ে পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছেন সিদ্ধার্থবাবু।
এনআরএসের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, কম ওজনের সদ্যোজাতদের বড় অংশ আরওপি’র শিকার। এনআরএসের এসএনসিইউ-ইনচার্জ অসীমকুমার মল্লিক বলেন, ‘‘শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। সর্বত্র এক ছবি। সদ্যোজাতকে অক্সিজেন দিতে হবে খুব সাবধানে। ওষুধ যেমন যথেচ্ছ খাওয়ালে মারাত্মক বিপদ হতে পারে, অক্সিজেনও তা-ই। যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই। তার পরেও নজর রাখতে হবে।’’
এখানেই উঠে আসছে চিকিৎসক-সচেতনতার প্রসঙ্গ। রাজ্যে প্রথম বার ক্ষমতায় এসে প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যুহার কমাতে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত তারই তত্ত্বাবধানে জেলায় জেলায় এসএনসিইউ হয়েছে। টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁরা এসএনসিইউয়ের মেডিক্যাল অফিসারদের সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মেডিক্যাল কলেজগুলোয় আরওপি স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে। ‘‘রাজ্যে মোট ষাটটা এসএনসিইউ। মৃত্যুর হার কমেছে। ম্যাজিকের মতো রাতারাতি তো সব হয়ে যাবে না!’’— মন্তব্য ত্রিদিববাবুর। ধাপে ধাপে সব সঙ্কটের সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান।