আব্বু কখন আসবে গো, প্রশ্ন খুদের

আমার আব্বু কখন আসবে গো? আব্বু কি রাতের ট্রেনে ফিরবে?’’

Advertisement

সুজাউদ্দিন

জলঙ্গি শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০১:৩৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

চার বছরের সুরাইয়া শবনম সেই সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যান করছে। মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করছে আর নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। বার বার মায়ের কাছে গিয়ে সে বলছে, ‘‘পাশের বাড়ির মইনুদ্দিন চাচা কেরল থেকে বাড়ি চলে এল। ও পাড়ার কত লোকও চলে এল। আব্বু এখনও এল না কেন। আমার আব্বু কখন আসবে গো? আব্বু কি রাতের ট্রেনে ফিরবে?’’

Advertisement

রাকিনা বিবি চুপ করে আছেন। ছোট্ট মেয়েকে তিনি কী বলবেন? তাঁর কাছেও তো স্পষ্ট উত্তর নেই। তাঁরও গলাটা কেমন নোনতা নোনতা লাগছে। চোখটা কি জ্বালা করছে?

সুরাইয়া ছোট। সে অতশত বোঝে না। বুঝতেও চায় না। সে শুধু তার আব্বুকে চায়। সে চায়, আব্বু ব্যাগ কাঁধে করে ঘরে ফিরবে। তার নাম ধরে ডাকবে। আর সে একছুটে গিয়ে লাফিয়ে উঠবে আব্বুর কোলে।

Advertisement

মায়ের ফোনটা নিয়ে সে খুঁজে বের করে আব্বুর ছবি। তার পরে সবুজ বোতামে চাপ দিয়ে ফোনটা সে কানে ধরে। দীর্ঘক্ষণ ধরে একটা যান্ত্রিক আওয়াজের পরে ফোনটা কেটে যায়। কোনও রিং হয় না। ও প্রান্ত থেকে সুরাইয়ার আব্বুও ‘হ্যালো’ বলেন না।

অন্য দিন হলে রাকিনা বিবি মেয়েকে একটু বকে দিত। কিন্তু এ দিন তিনি কিছু বলেননি। বরং ইদের আগে পড়ন্ত বেলায় মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরও চোখ দু’টো ছলছল করছে। কথা বলতে গিয়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায়।

মায়ের কাছে উত্তর না পেয়ে সুরাইয়া ছুটে গিয়েছে কখনও দাদুর কাছে, কখনও দাদির কাছে। তার সেই এক প্রশ্ন— ‘আমার আব্বু কখন আসবে গো।’

আজ, বুধবার ইদুজ্জোহা। তার আগের দিন মঙ্গলবার জলঙ্গির নওদাপাড়ার মোল্লা পরিবারের কারও মন ভাল নেই। রোজগেরে ছেলে সেলিম মোল্লা যে কেরল থেকে ঘরে ফিরতে পারেননি। কেনা হয়নি একমাত্র মেয়ের জন্য লাল টুকটুকে একটা ফ্রক। আর এ বার ইদের দিনে তিনি ফিরতেও পারবেন না। কারণ, কেরল থেকে বাড়ির জন্য তিনি রওনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সাঁতার জল পেরিয়ে ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে ছাড়তে চায়নি কেরল পুলিশ ও স্থানীয়েরা।

সেলিমের মা রৌশনারা বিবি বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার ফোনে ছেলে বলেছিল, আমি বাড়ির জন্য রওনা দিচ্ছি। ইদের আগেই পৌঁছে যাব। অনেক দুশ্চিন্তার মাঝেও খুশি হয়েছিলাম ইদের আগে ছেলেটা ঘরে ফিরবে। কিন্ত তার ঘণ্টা কয়েক পরেই জানিয়েছিল, কেরল পুলিশ তাকে ঝুঁকি নিয়ে বেরোতে দেয়নি। পথেই আটকে দিয়েছে। ইদে ঘরে ফেরা হল না ছেলেটার।’’

এর পরে আর কথা বলতে পারেননি রৌশনারা। রৌশনারা একা নন, ডোমকল-জলঙ্গিতে এমন অনেক পরিবারেই ইদের মানেটাই বদলে গিয়েছে। কোথাও বিষাদ, কোথাও আতঙ্ক। অনেকে এখনও কেরলে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। তাঁরা সেখানে কেমন আছে, কী ভাবে আছে, কী খাচ্ছে সে সব ভেবেই রাতের ঘুম উড়েছে পরিবারগুলির।

তাঁরা কেউ খবর না পেয়ে এখনও তাকিয়ে পথ চেয়ে আছেন। কেউ আবার ফোনটা নিয়ে চেষ্টা করছেন, এক বার যদি কথা বলা যায়! অনেকে আবার পাড়ার যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁদের বাড়িতে ঘন ঘন গিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন কেরলের হাল হকিকত। তার পরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই। ইদের আগের চেনা সন্ধ্যাটা তাই বদলে গিয়েছে। জিতপুরের নুরজাহান বিবি বছর দুয়েকের মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন। সদর দরজায় আওয়াজ শুনে কোনও বৃদ্ধা ছুটে গিয়েছেন, ‘‘কী রে, খোকা এলি নাকি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন