সঘন বরষায় ৭

বর কোলে, কাদায় ধপাস কন্যে

দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি বা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন, কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার।দারুণ দহন অন্তে সে এসেছে — ভরা নদী, স্কুল-ছুটি, চপ-মুড়ি বা নিঝুম দুপুর-রাতে ব্যাঙের কোরাস নিয়ে সঘন বরষা রয়েছে কি আগের মতোই? কিছু প্রশ্ন, কিছু স্মৃতি নিয়ে সেই কাদা-জলে পা রাখল আনন্দবাজার।

Advertisement

অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ১১:১০
Share:

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

টাপুর টুপুর বৃষ্টিতে ভরা নদীর দু’কুল ছাপিয়ে বান। এমন দুর্যোগের দিনেই কি না বিয়ে করলেন শিবঠাকুর। তাও আবার এক সঙ্গে তিন কন্যাকে।

Advertisement

জটাধারীকে এমন দিনেই বিয়ে করতে হল? ঘোর বর্ষায় বিয়ে করে কী ঘটেছিল? কৌতূহল চেপে রাখতে পারেননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লিখলেন, ‘‘...শিবঠাকুরের বিয়ে হল/ কবেকার সে কথা/ সেদিনও কি এমনিতরো/ মেঘের ঘটাখানা।/ থেকে থেকে বাজ বিজুলি/ দিচ্ছিল কি হানা/ তিন কন্যে বিয়ে ক'রে/ কী হল তার শেষে...’’

এ প্রশ্নের উত্তর না মিললেও এটা বোঝা যায় যে, বর্ষার সঙ্গে বিয়ের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। দুর্যোগ, দুর্ভোগ উপেক্ষা করেই বর্ষাকালে সাত পাকে বাঁধা পড়তে বাঙালি দিব্যি ভালবাসে।

Advertisement

বছর চল্লিশ আগের কথা। আষাঢ় পেরিয়ে সবে শ্রাবণ এসেছে। কয়েক দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি। সদ্য ছাদনাতলা ঘুরে এসেছেন অনিল মণ্ডল। বিয়ের সব আচার এখনও মেটেনি। নিধিনগরের মণ্ডল দম্পতিকে অষ্টমঙ্গলায় যেতে হবে হরিহর পাড়ার বহরানে। হাঁটুডোবা কাদায় পাড়ি দিতে হবে প্রায় আট কিলেমিটার পথ। চল্লিশ বছর আগে সে পথে এক মাত্র বাহন বলতে ছই দেওয়া গরুর গাড়ি।

তেমন গাড়িও গোটা গ্রামে বড়জোর দু’চারটে থাকত। মোড়ল বাড়ি থেকে চেয়ে আনা হল সেই ছইওয়ালা গাড়ি। বিছানো খড়ের উপরে বসে দুলতে দুলতে চললেন নবদম্পতি। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ছইয়ের ভিতরে ‘অনুরোধের আসরে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে...।’ শ্রাবণ-বিকেলে হাসছেন বৃদ্ধ অনিল মণ্ডল, ‘‘আসলে রেডিওটা পেয়েছিলাম বরপণ হিসেবে। বিয়ের পরে প্রথম সেই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার রোমাঞ্চ কি ভোলা যায়!”

শালপাতা, বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি সেই ছই দেওয়া গাড়ির সব থেকে চাহিদা ছিল বিয়ের সময় ও শ্রাবণ মাসের শেষ সপ্তাহে। বিয়ের বছরে ভাদ্র মাসে নববধূর মায়ের বাড়িতে থাকার চল রয়েছে। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে সেই গাড়িতে নববধূ যেতেন বাবার বাড়ি। কয়েক দশক আগেও বর বিয়ে করতে যেতেন ঘোড়া কিংবা পালকি চেপে। বর্ষায় ভরসা ছিল ছই দেওয়া গরুর গাড়ি। গরুর গলায় ঘন্টি বাঁধা থাকত। টুং টুং আওয়াজে বরের গাড়ি চলত আগে আগে। পিছনে ছই দেওয়া আরও কয়েকটি গরুর গাডির ‘কনভয়’। তাতে থাকতেন বরযাত্রীরা। মহিলাদের গাড়ির ছইয়ের খোলা দুই মুখ পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকত।

বছর পঁয়ত্রিশ আগে বিয়ে করে ফেরার পথে যে কী হ্যাপা হয়েছিল তা আজও স্পষ্ট মনে আছে খড়গ্রামের পারুলিয়ার বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের। সে বারও ঘোর বর্ষা। বরযাত্রী নিয়ে ফেরার সময় কাদায় পুঁতে গেল বরের গাড়ির চাকা। গাড়োয়ান হাজার চেষ্টা করেও পারলেন না। বরযাত্রীরা নেমে ঠেলা দিয়েও গাড়ি কাদা থেকে তোলা গেল না। শেষতক ঠিক হল, নবদম্পতিকে কোলে করে নামিয়ে খালি গাড়ি কাদা থেকে তোলা হবে। বর নির্বিঘ্নে কোলে উঠলেন। টাল সামলাতে না পেরে নববধূ আছাড় খেয়ে সটান কাদায়। বৈদ্যনাথ বলছেন, “ওই ঘটনা নিয়ে বৌয়ের কাছে ও শ্বশুরবাড়িতে বিস্তর খোঁটা খেতে হয়েছে।”

বিদ্যুৎ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক লালগোলার আব্দুল মতিনের বিয়ের পরের দিন বৌভাত। মাথার উপরে সামিয়ানা টাঙানো। সবে খেতে বসেছেন অতিথিরা। ঠিক সেই সময় আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। আব্দুল মতিন বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে কলাপাতার থালা থেকে মাংস, দই, মিষ্টি গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। বর্ষায় বিয়ের ঝক্কিও কি কম ভায়া!’’

আর নদীর ধারে যাঁদের বাস, তাঁদের চিন্তা বারো মাস! বিয়ে-শাদির সময় নদীপারের লোক অতশত ভাবতেন না। চার দিকে তখন জল আর জল। ছই দেওয়া আট-দশটি নৌকা সারি বেঁধে চলত বিয়ে বাড়ির দিকে। সঙ্গে বাজত দম দেওয়া কলের গান। বিয়ে-পর্ব শেষ। নবদম্পতি পা বাড়িয়েছেন নিজের ঘরে। বাইরে শ্রাবণ-ধারা। আর রেডিও ধরেছে, ‘এই রাত তোমার আমার...।’

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন