রেফার টু নার্সিংহোম

ওখানে কিছুই হবে না, বৌটা অকালে মরবে

গত কয়েক বছরে সরকারি হাসপাতালের হাল বেশ বদলেছে। দুর্গন্ধ উধাও। দু’বেলা ন্যাতা বোলানো ঝকঝকে মেঝে। রোগী এলে ফেরাচ্ছে না হাসপাতাল। জেলার প্রথম সারির ডাক্তারেরা মজুত।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৭ ০১:৪০
Share:

গত কয়েক বছরে সরকারি হাসপাতালের হাল বেশ বদলেছে। দুর্গন্ধ উধাও। দু’বেলা ন্যাতা বোলানো ঝকঝকে মেঝে। রোগী এলে ফেরাচ্ছে না হাসপাতাল। জেলার প্রথম সারির ডাক্তারেরা মজুত। হাজির প্রশিক্ষিত নার্সেরা। হাতের নাগালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। সর্বোপরি বিনে পয়সায় চিকিৎসা।

Advertisement

তবু রমরম করে চলছে নার্সিংহোম ব্যবসা। লোকে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে, টাকা খরচ করছে জলের মতো। কেন? দেখে নেওয়া যাক কিছু নজির:

হাসপাতালে লাইন

Advertisement

বহরমপুরের সৈয়দ তৌফিকুল ইসলামের দিদার হিপ জয়েন্ট ভেঙে গিয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা জানায়, ছ’মাসের আগে অস্ত্রোপচারের দিন পাওয়া যাবে না। ওই অবস্থায় বেশি দিন বিছানায় পড়ে থাকলে বেডসোর হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই বাধ্য হয়েই বহরমপুরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। পরের দিনই অস্ত্রোপচার।

পারি না, পারব না

মোটরবাইক দুর্ঘটনায় পায়ের পাঁচ জায়গা ভেঙেছিল ট্র্যাফিক পুলিশ অভিজিৎ নাগের ছেলের। তাঁর বক্তব্য, এই অবস্থা সামাল দেওয়ার পরিকাঠামো নেই জানিয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলকাতায় রেফার করে দিয়েছিল। বহরমপুরে নার্সিংহোমে ছেলেকে ভর্তি করান তিনি।

অ্যাম্বুল্যান্স চালক

১) মাসখানেক আগে মোটরবাইক থেকে পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন শান্তিপুরের সুমিত সিংহ। স্থানীয় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল রেফার করে কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে। সুমিতের বন্ধু বকুল মণ্ডলের কথায়, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়ার সময়ে চালক বারবার বলতে থাকেন, এতটা রাস্তা যেতে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। তার চেয়ে রানাঘাটে এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে ভাল।’’ সেখানে গিয়ে ২৩ হাজার টাকা গুণাগার দেন তাঁরা। পরের দিন ছুটি।

২) চাকদহের দুবড়া গ্রামের ভূষণ বিশ্বাস জানতেন, হাসপাতালে বিনে পয়সায় চিকিৎসা হয়। পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন চাকদহ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, ব্লাডারে পাথর হয়েছে। অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। চাকদহে সেই সুবিধা নেই। যেতে হবে কল্যাণী জেএনএমে। হাসপাতালের বাইরেই ভূষণের দুই দাদাকে এক অ্যাম্বুল্যান্স চালক বলেন, তিনি কল্যাণী যেতে পারেন, ১২০০ টাকা লাগবে। হাজার টাকায় রফা হয়। যাওয়ার পথে চালক জানান, হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে সময় লাগবে। অসুবিধা বুঝলে আবার কলকাতায় রেফার করবে। তার চেয়ে কল্যাণীতেই নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া ভাল। আজ অস্ত্রোপচার, কাল ছুটি। শেষে তাই হল, গুণাগার ২১ হাজার।

হাতুড়ের হাত

ডোমকলের কুপিলা গ্রামের সরিফুল মণ্ডলের স্ত্রী পেটে যন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জলঙ্গির সাদিখাঁড়দেয়াড় হাসপাতালে। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর থেকে তাঁকে বারবার ফোন করতে গ্রামেরই এক পরিচিত হাতুড়ে। বলতে থাকেন, ‘সরকারি হাসপাতালে কিচ্ছু হবে না। ওদের ভরসায় থাকলে বৌটাকে অকালে হারাতে হবে!’’ ঘাবড়ে যান সরিফুল। শেষমেশ স্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে এনে ডোমকলের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে তোলেন। সেটিরও কর্তা এক হাতুড়ে। তিনি পেটে স্টেথো বসিয়ে বলেন, ‘‘এ তো বড় বিপদ! অ্যাপেনডিসাইটিস হয়েছে। এখনই পেট কেটে অ্যাপেনডিস্ক বাদ না দিলে তা ফেটেই উনি মারা যাবেন।’’ গাঁয়ের চাষি সরিফুল ঝুঁকি নিতে পারেননি। দুই হাতুড়ের হাতযশে কোনও রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শেষে রাতে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। সরিফুল বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, ফাঁড়া কাটল। বাড়ি নিয়ে গেলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই যন্ত্রণা ফিরে এল। হাতুড়েকে বলতে গেলেই বলত, ওটা গ্যাসের ব্যথা।’’ বছরখানেক পরে স্ত্রীকে বহরমপুরে নিয়ে গিয়ে ফের অস্ত্রোপচার করাতে হয় সরিফুলকে। তখনই তিনি টের পান, কী ভাবে ঠকেছেন। অভিযোগ জানাননি কোথাও। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরিফুল বলেন, ‘‘কাকে আর বলব? কর্তারা ওদের হাতে কেনা!’’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন