যন্ত্রে মন্ত্র। নিজস্ব চিত্র
প্রতিমার সামনে থরে থরে সাজানো ষোড়শোপচারের মধ্যে বইটিও রয়েছে। মলাটের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘অখণ্ড পুরোহিত দর্পণ’। আর সেই ঢাউস বই নিয়ে রীতিমতো নাজেহাল পুরোহিত মশাই। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সৌজন্যে এই চেনা ছবিটা এ বার বদলে যাচ্ছে। ছিপছিপে ফোনে আঙুল ছোঁয়ালেই ভেসে উঠছে পুজোর মন্ত্র, পুজোর পদ্ধতি এমনকী বাংলা হরফে লেখা চণ্ডী। পৌরহিত্যে আগ্রহী তরুণ প্রজন্ম ‘পুরোহিত দর্পণ’ ছেড়ে এখন ভরসা রাখছেন ওই পিডিএফ-এ।
১৩১১ বঙ্গাব্দে কলকাতার সত্য নারায়ণ লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পুরোহিত দর্পণ। সংকলন করেছিলেন পণ্ডিত সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। যদিও এটাই পুরোহিত দর্পণের আদি সংস্করণ কি না তা নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। ১৩২৯-এ কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ সংকলিত চার খণ্ডের পুরোহিত দর্পণ প্রকাশ করেন পিএম বাগচি প্রকাশনা। পরে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকাশনার তরফে হরেক নামে প্রকাশ হয়েছে পুজোবিধির একাধিক গ্রন্থ। তার চাহিদা তুমুল। দুর্গাপুজো তো বটেই, বিয়ে, শ্রাদ্ধ এমনকী পাড়ার মোড়ে শীতলা, মনসা পুজোয় পুরোহিতদের সর্বক্ষণের সঙ্গী এই বই। শতবর্ষ পেরিয়ে এ বার কি তা হলে ‘পুরোহিত দর্পণ’-এর দিন ফুরলো?
নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধ জননী সভা পরিচালিত পৌরহিত্য পাঠক্রমের ছাত্র অংশুমান চক্রবর্তী, সুজয় গোস্বামী, বুদ্ধদেব আচার্যেরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা তো বিভিন্ন কাজে মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করছি। সারাক্ষণ ফেসবুক, হোয়াটস-অ্যাপ করছি। দুর্গাপুজোর সব কিছুই যখন ইন্টারনেটে মিলছে। তখন ব্যবহার না করাটাই বোকামি।’’
মুর্শিদাবাদের প্রবীণ পুরোহিত লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, কিংবা ব্রহ্মপুর পুরোহিত সমাজের বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা জানাচ্ছেন, সময়ের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারলে চিরায়ত পৌরহিত্য ব্যাপারটাই তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিশ্বনাথবাবুর কথায়, ‘‘যদি পুজো বা শ্রাদ্ধের ফর্দ হোয়াটস-অ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে ফোন দেখে মন্ত্র পড়তেই বা দোষ কোথায়?”
তবে ভাটপাড়ার প্রবীণ পুরোহিত ষষ্ঠীপদ ভট্টাচার্য অবশ্য প্রযুক্তির এই ব্যবহার মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ সবই ঘটছে মানুষের স্মৃতিশক্তির অক্ষমতার কারণে। পুজো করতে বসে স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে মন্ত্র উচ্চারণ করা বা পুজো পদ্ধতির হদিস নেওয়া আমার মতে শিষ্টাচার বিরোধী।” ভাটপাড়ার এক পুরোহিত তপন ভট্টাচার্য প্রায় একই সুরে বলেন, ‘‘মানছি সময় বদলেছে। তবুও এখনও বহু জায়গায় স্বতন্ত্র পুঁথি অনুসারে দুর্গাপুজো হয়। স্মার্টফোন কি সেই পুঁথির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে?’’
নবদ্বীপ বঙ্গবিবুধ জননী সভার সুশান্ত ভট্টাচার্যের যুক্তি, এই সব মন্ত্রের বেশির ভাগই বৈদিক ঋষিদের সৃষ্টি। বেদের যুগে পুঁথি কোথায়? সবই শ্রুতি নির্ভর ছিল। অনেক পরে গাছের ছাল বা পাতায় সেই সব মন্ত্র লিখে তৈরি হল পুঁথি। ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার পরে সেই পুঁথির মন্ত্র উঠে এল ছাপা কাগজে। আরও পরে ‘পুরোহিত দর্পণের’ মতো বই। এটা যদি সকলে মেনে নিতে পারেন, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে অসুবিধা কোথায়? যা শুনে মুর্শিদাবাদের ৬৭ বছরের পুরোহিত লক্ষীনারায়ণ বলছেন, ‘‘অসুবিধা নেই তো! পুজোর জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। ফোনেই সব ডাউনলোড করে নিয়েছি। পুজোর ফাঁকে মোবাইল অন করে চোখ বুলিয়ে নিলেই হ’ল।’’