প্রকাশ্য রাস্তায় ‘কাস্টমার’ ধরার ভিড় করেন অস্থায়ী যৌনকর্মীরা, পথচারীরা অস্বস্তিতে

বাসের অপেক্ষায় থাকা ছাত্রী-তরুণী দেখেও দর শুধোয় খদ্দের

সন্ধ্যে নামলেই শহরের ব্যস্ত রাস্তার ধারে তাঁরা জমা হতে শুরু করেন। চড়া মেকআপ, পোশাক-আশাক অন্য রকম, চোখেমুখে প্রগলভতা। চোখের ইশারা, হাতের ইঙ্গিত চলতে থাকে। চলতি পথে অনেকেই সেই ইশারায় থমকে এগিয়ে যান।

Advertisement

মনিরুল শেখ

কল্যাণী শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:২১
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সন্ধ্যে নামলেই শহরের ব্যস্ত রাস্তার ধারে তাঁরা জমা হতে শুরু করেন। চড়া মেকআপ, পোশাক-আশাক অন্য রকম, চোখেমুখে প্রগলভতা। চোখের ইশারা, হাতের ইঙ্গিত চলতে থাকে। চলতি পথে অনেকেই সেই ইশারায় থমকে এগিয়ে যান। বেশ কিছু গাড়ি, মোটরবাইক এসে থামে তাঁদের সামনে। তাঁরা তাতে উঠে পড়েন।

Advertisement

কাজের খাতিরে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। অস্বস্তিতে পড়েন তাঁরা, বিশেষত মহিলারা। পুরুষদের অনেককেও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয় অনেক সময়। কল্যাণী শহরের একাধিক প্রান্তে এবং স্টেশন চত্বরে এই ‘ফ্লাইং সেক্সওয়ার্কার’ বা অস্থায়ী যৌনকর্মীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে ক্ষোভ বাড়ছে নাগরিকদের। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রের খবর, যেখানে যৌনকর্মীরা দাঁড়াচ্ছেন সেখানে খদ্দের হিসাবে অনেক সমাজবিরোধী আসছে। তাদের জন্য অপরাধমূলক ঘটনা বাড়ছে। নিজেদের মধ্যেও তারা অনেকসময় মারামারিতে জড়াচ্ছেন। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, বেশ কয়েকটি ঘটনায় একাধিক যৌনকর্মী আহত এবং নিহত হয়েছেন।

যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুর্বার মহিলা সমন্বর সমিতির শাখা রয়েছে নদিয়াতেও। সেখানে তাদের সংগঠনের দায়িত্বে থাকা বিকাশ বণিক বলেন, ‘‘শান্তিপুর ছাড়া নদিয়ার কোথাও আলাদা যৌনপল্লি নেই। কিন্তু মানুষের চাহিদা থাকবেই। ফলে কল্যাণী, কৃষ্ণনগরের মতো শহরের ভিতর ব্যস্ত এলাকা, রাস্তা, বাজারের ধারে যৌনকর্মীরা খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়ান। এঁরা সংগঠনের মধ্যে আসতে চান না। ফলে এঁদের মধ্যে সচেতনতা অভিযানও চালানো যায় না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শহরে আলাদা যৌনপল্লী না-থাকলে এই সমস্যা থাকবেই। প্রশাসনের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।’’ নাগরিকদের একাংশের দাবি, প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যৌনকর্মীদের চোখের ইশারা বা শরীরী বিভঙ্গের মাধ্যমে খদ্দের ডাকা বা ‘সলিসিটিং’ নিষিদ্ধ। কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয় না। নদিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার অবশ্য

Advertisement

বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে জেলার একাধিক আইসি এবং ওসি-র সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের ব্যবস্থা নিতে

বলা হয়েছে।’’

ব্যারাকপুর-কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে কল্যাণীর বুদ্ধপার্ক। শহরের অন্যতম জমজমাট এই এলাকার রাস্তার রয়েছে একাধিক হোটেল। কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা সেখানে যেতে ইতস্তত করেন। কারণ, দুপুর থেকেই অধিকাংশ হোটেলে রমরমিয়ে মধুচক্র চলে। আশপাশের বাসিন্দারাই জানালেন, চাকদহ, রানাঘাট, উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি, হালিশহর, হুগলির ত্রিবেণী, ব্যান্ডেলের মতো এলাকা থেকে অনেক মেয়ে প্রতিদিন ট্রেনে চেপে বুদ্ধপার্কে চলে আসে এই ব্যবসার জন্য। অভিযোগ, পুলিশ সব জেনেও নিশ্চুপ। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানালেন, বুদ্ধপার্কেপ হোটেলগুলিতে মধুচক্র এমন ডালাপালা ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে রাতের খাওয়া খেতে গেলেও মানুষজন সন্দেহের চোখে তাকান।

অভিযোগ রয়েছে, রাতের দিকে জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এক প্রতিবন্ধী যুবক এসে দাঁড়ান। তাঁর সঙ্গে থাকেন কয়েক জন মহিলা। তাঁরা খদ্দের ধরা শুরু করেন। অভিযোগ, এঁদের জন্য রাতে হাসপাতাল-সংলগ্ন ওই এলাকায় মহিলা ডাক্তার বা রোগীর মহিলা আত্মীয়রা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ছেন। কৃষ্ণনগর স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ও টিকিট কাউন্টারের সামনেও সকাল থেকে ঘুরে বেড়ান কিছু মহিলা। অনেককে দেখা যায় কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ডেও। অভিযোগ, বিকেলের দিকে ছাত্রী বা গৃহবধূরা বাস বা অটো ধরার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়ালে অনেক খদ্দের ভুল করে তাঁদের কাছে এসে দরাদরি শুরু করেন, অশ্লীল কথা বলেন বা গাড়ির দরজা খুলে দেন।

জাতীয় সড়কের ধারে বাহাদুরপুরে রাস্তার ধারে রয়েছে বহু হোটেল। সন্ধ্যা হতেই শান্তিপুর, হাঁসখালি থেকে মহিলারা চলে আসেন হোটেলগুলিতে। জাতীয় সড়ক দিয়ে মোটরবাইক যেতে দেখলেই হোটেলগুলি থেকে টর্চের আলো ফেলে খদ্দের ধরার জন্য সঙ্কেত দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এর জন্য দৈনিক ১০০ টাকার বিনিময়ে লোক নিয়োগ করেন হোটেল মালিকেরা। ধুবুলিয়ার বাসিন্দা জহর আলি বলেন, ‘‘এক বার নবদ্বীপ কলেজে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে মোটরবাইক থামিয়ে একাধিক হোটেলের কর্মী জিজ্ঞাসা করতে থাকেন ঘর লাগবে কিনা। লাগবে না জানালে তাঁরা জানান, যৌনকর্মীও পাওয়া যাবে। তাঁদের নিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যাবে। কোনও রকমে সে দিন ওদের খপ্পর থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন