তাঁরা কেউ কাউকে চিনতেন না। তাঁদের উপর অপরাধের ভয়াবহতা তাঁদের মিলিয়ে দিল। তাঁরা দেখা করলেন, ভাগ করে নিলেন যন্ত্রণা, হাসপাতালে একসঙ্গে প্রার্থনাও করলেন। একজন রানাঘাটের বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনী, অন্য জন রানাঘাট থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের মালিয়াপোতা গির্জার প্রাক্তন প্রধান যাজক টি জে আব্রাহাম।
রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনা শুনে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন আব্রাহাম। বর্তমানে তিনি ব্যারাকপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু রানাঘাটের ভয়ঙ্কর ঘটনা তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তেহট্টে, ১৩ বছর আগের ২৪ ডিসেম্বরে। খ্রিসমাসের আগের সন্ধ্যায় বড়দিনের উপাসনায় যিশুর উপদেশ শোনাচ্ছিলেন আব্রাহাম। কনকনে ঠান্ডায় গির্জার বাইরে জমাট কুয়াশা। ভিতরে উপাসনায় ব্যস্ত হাজার দেড়েক মহিলা, পুরুষ ও শিশু। বাইরের ঠান্ডা যাতে ভিতরে না আসে সেই জন্য প্রধান দরজা ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উপাসনা কক্ষের আর সব জানালা, দরজা।
আচমকা সেই কুয়াশা ফুঁড়ে উঠে এসেছিল জনা তিরিশ দুষ্কৃতী। তাদের হাতে দা, কুড়ুল, বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র। গির্জায় ভক্তদের দান সমস্ত টাকাপয়সা লুঠপাটের পর যাজক, ভক্তদের বেদম মারধর করে ‘অপারেশন’ সেরে মিলিয়ে যায় রাতের কুয়াশায়। পুলিশ আসার আগে দুষ্কৃতীরা চলে গিয়েছিল বহু দূরে। যন্ত্রণা উপেক্ষা করে রক্তাক্ত অবস্থাতেই সেই রাতে উপাসনা সম্পূর্ণ করেছিলেন যাজক ও ভক্তেরা।
রানাঘাটের ঘটনা শোনার পরে সেই রাতের অভিঘাত আবার যেন নিজের ভিতর অনুভব করেছেন আব্রাহাম। তিনি আর দেরি করেননি। গত সোমবারেই নির্যাতিতা সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। টেলিফোনে আব্রাহামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আব্রাহাম বলেন, “অসম্ভব আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন ওই সন্ন্যাসিনী। বারবার তিনি বলছিলেন, আফ্রিকাতেও তিনি কাজ করেছেন। সেখানেও একবার চুরির ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু রানাঘাটের এই ঘটনায় তিনি ভয়ঙ্কর আঘাত পেয়েছেন।”
আব্রাহাম জানান, ওই সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে তাঁর প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হয়েছে। “তাঁর অসম্ভব আধ্যাত্মিক ক্ষমতাই তাঁকে এই বিরাট ধাক্কা থেকে রক্ষা করছে,” বলেন তিনি।
একা আব্রাহাম নন, ২০০২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতের সেই ঘটনা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে তামাম মালিয়াপোতা। সে দিন উপাসনায় সপরিবার উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক আগাপিত মণ্ডল। ৭৬ বছরের ওই প্রৌঢ়ও আজও চোখ বন্ধ করলেই সেই রাতের ঘটনা দেখতে পান। সংবাদমাধ্যমে রানাঘাটের ঘটনা শোনার পরে চমকে ওঠেন তিনিও। বলছেন, “সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় লাগে। আর রানাঘাটে তো সব ছারখার হয়ে গেল!”
মালিয়াপোতা গির্জার গা লাগোয়া বাড়ি সুনন্দা মণ্ডলের। বলছেন, “আমরাও ১৩ বছর আগের সেই রাতে উপাসনা কক্ষে ছিলাম। কী ভয়ঙ্কর সেই রাত! প্রার্থনা করছি, ওই সন্ন্যাসিনী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরুন।”
কিন্তু বিচার পাওয়া যাবে কি? মালিয়োপাতার ঘটনা নিয়েও হইচই হয়েছিল সারা বিশ্ব জুড়ে। ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে পুলিশ বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে। পরে উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে তারা ছাড়াও পেয়ে যায়। রানাঘাটে কী হবে? যিশুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আব্রাহাম বলেন, “ওই সন্ন্যাসিনী ও আমি, দু’জনেই অপরাধীদের ক্ষমা করেছি। যে ক্ষমা করে ঈশ্বরও তাঁকে ক্ষমাকরে। এই শিক্ষাই আমরা পেয়েছি। তাছাড়া ক্ষমা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। শাস্তি দেবে দেশের আইন।”
অপরাধীকে ক্ষমা কিন্তু অপরাধের বিচার প্রার্থনা, একই সুতোয় বাঁধা পড়ল রানাঘাট আর মালিয়াপোতা!