ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল ১২ বগির রানাঘাট-শিয়ালদহগামী ডাউন রানাঘাট লোকাল। পড়ি কি মরি করে ছোটেন ভদ্রলোক। চিন্তার কারণ একটাই— অফিস টাইম। যদি জায়গা না মেলে। সঙ্গে অসুস্থ স্ত্রী। এতটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
যদিও ট্রেনে উঠে দেখেন— কোথায় কী! ভোঁ ভাঁ। এক জন মাত্র যাত্রী বসে আছেন। বাদ বাকি সব আসন ফাঁকা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন দম্পতি। বসতে যেতেই চোখ পড়ে ট্রেনের আসনগুলোর দিকে। সেগুলো খবরের কাগজে ঢাকা। বসে থাকা যাত্রী গলা ভারী করে জানালেন, ‘সিট বুক করা আছে, বসবেন না’।
মানে কী? কোথাও কোনও লোক নেই, অথচ বসা যাবে না? প্রশ্ন করতেই ধেয়ে এল উত্তর, ‘এটাই হয়ে আসছে দাদা। বসবেন না’।
বৃহস্পতিবার সকালে রানাঘাট স্টেশনের ঘটনা। রানাঘাটের সুভাষপল্লীর বাসিন্দা সঞ্জিত ও পদ্মাবতী ঘোষকে শেষমেশ ট্রেনের ওই কামরা থেকে নেমে যেতে হয়। তর্কাতর্কি করে কোনও লাভ হয়নি। রক্ষা মেলেনি পাশের বগিতে উঠেও। মিনিট খানেক পরে আরও কয়েক জন লোক জুটিয়ে তাদের কামরায় উঠে চোখ রাঙিয়ে যান ওই যাত্রীটি। ভয়ও দেখানো হয়। শেষমেশ ট্রেন থেকে নেমেই পড়েন তাঁরা। রেল পুলিশের দ্বারস্থ হন। লিখিত অভিযোগও জানান। কিন্তু খবর পেয়ে পুলিশ যতক্ষণে যায়, ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গিয়েছে। ঘণ্টা তিনেক পরে অন্য ট্রেন ধরে কলকাতায় যান তাঁরা।
নিত্যযাত্রীদের এ হেন দাপট অবশ্য নতুন কিছু নয়, বলছেন অনেকেই। কেউ কাগজ রেখে তো কেউ রুমাল রেখে দেয়, কেউ কেউ আবার তাসের বান্ডিল দিয়ে জায়গা দখল করেন। ব্যস, তা হলেই আসন ‘সংরক্ষিত’। তার পর চুটিয়ে গল্প করতে করতে কিংবা তাস খেলতে খেলতে অফিস যাওয়া। প্রতিবাদ করলেই ‘শাস্তি’— মারধর কিংবা ভালয় ভালয় ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার ফতোয়া। ঠিক যেমনটা হয়েছে সঞ্জিতবাবুদের ক্ষেত্রে।
রানাঘাট জিআরপি-র আইসি দেবকুমার পাল বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এ ভাবে জায়গা দখল করে রাখা হয় বলেই আমরাও মাঝে মাঝে ট্রেনে হানা দিয়ে থাকি। আবার হানা দেওয়া হবে।”
পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সঞ্জিত ঘোষ বলেন, “আমার স্ত্রী অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর জন্য তাঁকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছিলাম। সেই সময় ওই ঘটনা ঘটে।” সঞ্জিতবাবু বলেন, “আমাদের সঙ্গে ওরা খুব খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করেছে। কটু কথা বলতে ছাড়েনি আমার স্ত্রীকেও। এমনকী আমার গায়ে হাতও তোলে। চিৎকার করে বলতে থাকে ওরা, এ বার তোদের কে বাঁচাবে? ভয়ে আমরা ট্রেন থেকে নেমে যাই।”
এমন ঘটনা যে নতুন নয়, জানা যায় স্থানীয় লোকজনের কথা থেকেও। স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ মজুমদার যেমন বলেন, “আমাকেও হেনস্থা হতে হয়েছে। দমদম থেকে আমার এক দিদি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তাকে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়ে দেখি বগির মধ্যে প্রায় সব জায়গায় খবরের কাগজ ও তাস রেখে জায়গা দখল করা রয়েছে। দিদিকে কাগজ সরিয়ে একটা জায়গায় বসাতেই গণ্ডগোল বেঁধে যায়।”
এ ধরনের কাজে পাশে মেলে না রেলযাত্রী সমিতিকেও। ‘ফেডারেশন অব শিয়ালদহ মেন লাইন প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী অবশ্য বলেন, “এ ভাবে জায়গা রাখা বেআইনি। আমরা এ ধরনের কাজকে সমর্থন করি না। যে-ই এ কাজ করুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
পূর্ব রেলের জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্রও বলেন, ‘‘কোনও যাত্রী নিজে বসতে পারেন। কিন্তু,অন্য কারও জন্য জায়গা দখল করে রাখতে পারেন না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, নজরদারির জন্য আরপিএফ এবং জিআরপিএফ রয়েছে। কিন্তু তারা না দেখলেই এ সব ঘটছে।
সত্যিই কি তাই?