রানিরঘাটে ফ্লেক্সেই পুজো হল গোপীনাথের। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
শেষ পর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যি হল। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ বাসন্তী অষ্টমীতে আসতে পারলেন না নবদ্বীপে। গোপীনাথকে যে আসতে দেওয়া হবে না সেই বার্তা রটে গিয়েছিল আগেই। তবুও একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে শেষ পর্যন্ত হয়তো ঠিকই আসবেন গোপীনাথ। সেই মতো সব আয়োজনও করা হয়েছিল। পরিষ্কার করা হয়েছিল গঙ্গার ঘাট। বাঁধা হয়েছিল মণ্ডপ। সোমবার সকাল থেকেই শ’য়ে শ’য়ে ভক্তেরা ভিড় করেছিলেন নবদ্বীপের রানিরঘাটে। কিন্তু অপেক্ষায় সার হল। গোপীনাথের নৌকো ঘাটে ভিড়ল না।
চৈত্রের দুপুরে গোপীনাথহীন গঙ্গার তীরের দিকে তাকিয়ে যেন ফুঁসছিল নবদ্বীপ। এমন ঘটনা মানতে পারছিলেন না কেউই। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের বারোদোলে কৃষ্ণনগর যাওয়া নিয়ে বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় ছেদ পড়ল কয়েশো বছরের প্রাচীন প্রথায়।
নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই বারোদোল উপলক্ষে অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ গঙ্গা দিয়ে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি যাওয়ার পথে নবদ্বীপ ছুঁয়ে যেতেন। নবদ্বীপে গঙ্গার রানিরঘাটে প্রতি বছর চৈত্রমাসে বাসন্তি পুজোর অষ্টমীতে আসতেন গোপীনাথ। তাঁকে ঘিরে লক্ষাধিক ভক্তের ভিড় জমত গঙ্গার ঘাটে। নৌকার উপরেই সারা দিন ধরে চলত তাঁর সেবা, পুজো, ভোগরাগ। গঙ্গার পাড়ে আয়োজন করা হত মহোৎসবের। বারো থেকে চোদ্দ হাজার মানুষ রাস্তার ধারে বসে তৃপ্তি করে খেতেন খিচুড়ি, পাঁচ তরকারি, চাটনি, পায়েস। মহোৎসবের শেষে রাত গভীর হলে গোপীনাথের নৌকো যাত্রা করত রাজবাড়ির উদ্দেশে।
নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আনুমানিক ১৭৬৪ সাল নাগাদ বারোদোলের মেলা প্রবর্তন করেন। রংদোলের পর একমাত্র কৃষ্ণনগরেই রাধাকৃষ্ণের বারোদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই বারোদোল। রাজবাড়ির পঙ্খের কাজ করা সুবিশাল ঠাকুর দালানের দক্ষিণ দিকে চাঁদনী। সেখানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ। নদিয়ারাজের কুলবিগ্রহ হল বড় নারায়ন। বারোদোলে বড় নারায়নের সঙ্গে আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ থাকেন। নামে বারোদোল হলেও সব মিলিয়ে মোট তেরোটি বিগ্রহ থাকত বারোদোলের উৎসবে। সেগুলি হল বলরাম, শ্রীগোপীমোহন, লক্ষ্মীকান্ত, ছোট নারায়ন, ব্রহ্মণ্যদেব, গড়ের গোপাল, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, নদীয়া গোপাল, তেহট্টের কৃষ্ণরায়, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রীগোবিন্দদেব ও মদনগোপাল। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্ব কালে বিরহী, বহিরগাছি, তেহট্ট, সুত্রাগড়, নবদ্বীপ কিংবা শান্তিপুরের মতো জায়গায় মন্দির নির্মাণ করে এইসব বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নদিয়ারাজ প্রদত্ত দেবোত্তর সম্পত্তিতে সারা বছর পুজার্চনা চলে।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “বারোদোল উপলক্ষে নৌকা করে কৃষ্ণনগরে যাওয়ার পথে আগে চৈতন্যধামে থামতেন গোপীনাথ। কিন্তু এভাবে গোপীনাথ নবদ্বীপেই আর আসবেন না এটা কেউই মেনে নিতে পারছেন না।”
নবদ্বীপের রানিরঘাটে গোপীনাথ উৎসবের উদ্যোক্তাদের অন্যতম নারায়নচন্দ্র সাহা বলেন, “আমরা সরাসরি অগ্রদ্বীপের মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলাম। ওঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, গোপীনাথকে কোথাও পাঠানো হবে না।” এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্যের মন্ত্রী তথা নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহাও। তিনি বলেন, “দেবতা কারও সম্পত্তি নন। কয়েকশো বছর ধরে যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তা এভাবে থামিয়ে দেওয়ার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করা।” গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমিতির সম্পাদক তথা চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, “কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা সেবা এভাবে বন্ধ করা যায় না। এটা চরম অন্যায়। ক্ষুদ্র স্বার্থে মানুষ যে কত হীন আচরণ করতে পারে এই ঘটনা তার সব থেকে বড় প্রমাণ।”
কালনা থেকে প্রতি বছর এই দিনে নবদ্বীপে গোপীনাথ দর্শনে আসেন প্রদীপ চক্রবর্তী। এদিনও এসেছিলেন। নবদ্বীপ রানিরঘাটে যেখানে গোপীনাথের নৌকো বাঁধা থাকত প্রতি বছর, সেদিকে তাকিয়ে বার বার আক্ষেপ করছিলেন তিনি, “এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে গোপীনাথ আসেননি।”
গোপীনাথ না এলেও মানুষ কিন্তু উৎসবের উপকরণ নিয়ে নবদ্বীপে চলে এসেছিলেন। স্থানীয় উদ্যোক্তারা সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা একটি ফ্লেক্সে গোপীনাথের বিগ্রহের প্রতিরূপ তৈরি করেছিলেন। নদীর পাড়ে প্রতি বছর যেখানে গোপীনাথের নৌকা থামে সেখানেই একটি সুসজ্জিত নৌকায় পুজোর আয়োজন করেছিলেন তাঁরা। তিন কুইন্টাল দুধের পায়েস ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় সেই পায়েস ভোগ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বৃদ্ধ মধুসূদন কংসবণিক বলছেন, “আমার জ্ঞানে এই প্রথম গোপীনাথ নবদ্বীপে আসছেন না। ভিতরটা কেমন যেন হাহাকার করছে।”