কিছু উপসর্গ ডেঙ্গির। কিছু উপসর্গ ইনফ্লুয়েঞ্জার। কিন্তু আসল রোগটা যে কী, তা ধরাই পড়ছে না।
জ্বর আসছে হঠাৎ করে। উঠে যাচ্ছে ১০৩-৪ ডিগ্রি। থাকছে চার-পাঁচ দিন। জ্বর চলে যাওয়ার পরে গায়ে দেখা যাচ্ছে লাল লাল ছোপ। ওই ছোপ যে ডেঙ্গির অন্যতম উপসর্গ তা এখন আর আম বাঙালির জানতে বাকি নেই। গায়ে লাল ছোপ দেখেই রক্ত পরীক্ষা করাতে ছুটছেন মানুষ। কেউ কেউ ভয়ে রোগীকে ভর্তিও করিয়ে দিচ্ছেন হাসপাতালে।
প্রাথমিক রক্ত পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর সেটাও যে ডেঙ্গিরই একটা উপসর্গ, তা-ও সকলের জানা। তাই ভয়টা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার গায়ে লাল চাকা দাগ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু গাঁটে গাঁটে ব্যথা হচ্ছে। ডেঙ্গি বা চিকনগুনিয়ার ক্ষেত্রে যেমন হয়। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এলে কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গি নয়, চিকনগুনিয়া নয়, ম্যালেরিয়াও নয়। আবার ইনফ্লুয়েঞ্জাও নয়। বেশ কিছু ক্ষণ স্যালাইন চলার পরে লাল ছোপ চলে যাচ্ছে। প্লেটলেট ফের উঠে যাচ্ছে। প্যারাসিটামলে জ্বর কমছে, গাঁটে ব্যথাও কমছে।
রোগটা তা হলে কী?
ভুক্তভোগী মানুষেরা তো বটেই, ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়াদের মতো পরজীবীদের নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরাও এই জ্বরের চরিত্র নিয়ে ধন্দে রয়েছেন। কেউ বলছেন ডেঙ্গিরই নতুন প্রজাতির কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। কেউ বা বলছেন, হানাদার জীবাণুটা ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনও জাতভাই হতে পারে। যত ক্ষণ পর্যন্ত জীবাণুটির প্রকৃতি চূড়ান্ত ভাবে বোঝা না যাচ্ছে, তত ক্ষণ সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির নিদানও দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। তা হলে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে কী ভাবে?
পরিস্থিতি সামলাতে চিকিৎসকদের অনেকেই নিজেদের মতো করে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি (ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল) তৈরি করে ফেলেছেন। ওই সব চিকিৎসকের অধিকাংশই বলছেন, প্যারাসিটামলই হল অজানা প্রকৃতির ওই জ্বরের আসল চিকিৎসা। যদি রোগী অধিক দুর্বল হয়ে পড়েন কিংবা গায়ে লাল লাল ছোপ দেখা যায়, তা হলে হাসপাতালে ভর্তি করে কিংবা বাড়িতেই স্যালাইনের ব্যবস্থা করলেই সামাল দেওয়া যাবে রোগটিকে।
তবে যে জীবাণুর সংক্রমণে গায়ে লাল চাকা দাগ হচ্ছে সেটি যে ডেঙ্গির প্রজাতির কোনও ফ্ল্যাভি ভাইরাস তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই পরজীবী বিজ্ঞানীদের। বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর এক পরজীবী বিজ্ঞানীর মন্তব্য, ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গির জীবাণু সংক্রমণে গায়ে যেমন লাল চাকা দাগ হয়, তেমনই কমে য়ায় রক্তের প্লেটলেট। আবার গাঁটে গাঁটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তিনটি উপসর্গের জন্য তিন ধরনের জিন দায়ী। এখন যে ভাইরাল জ্বরটা হচ্ছে তা হয়তো এমন এক ধরনের ডেঙ্গির জীবাণু যার মধ্যে গাঁটে ব্যথার জন্য দায়ী জিনটি নেই, কিন্তু অন্য দু’টি রয়েছে। আবার কোনও ক্ষেত্রে এমন নতুন প্রজাতির ডেঙ্গির জীবাণু এল যার মধ্যে আবার প্লেটলেট কমানোর জিনটি থাকবে না। সেই ডেঙ্গির জীবাণুতে মৃত্যুর আশঙ্কা কম থাকবে।
তবে জিনগত পরিবর্তনের ফলে প্রতিষেধক টিকার ভূমিকাটা কী দশা হবে তা নিয়ে শঙ্কিত চিকিৎসক-গবেষকেরা।
পরজীবী বিজ্ঞানী তথা ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর আশঙ্কা, ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ারা যে ভাবে দ্রুত তাদের জিনগত গঠন পরিবর্তন করছে তাতে বিভিন্ন রোগের টিকাকরণ পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তিনি বলেন, ‘‘সোয়াইন ফ্লু-র যে টিকাটি গত বছর এ দেশে দেওয়া হয়েছিল সেটি কাজ না করার কারণ ওই একই। যে প্রজাতির সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের নিরিখে টিকাটি তৈরি হয়েছে সেটি ভারতবর্ষে ২০১৩ সালে সক্রিয় ছিল। ২০১৪ আর ২০১৫ সালে যে সোয়াইন ফ্লু-র প্রজাতির সংক্রমণ হয়েছিল তাদের প্রজাতি আলাদা। তাই টিকা দিয়েও রোগ ঠেকানো যায়নি।’’ এমন প্রশ্ন ওঠায় ডেঙ্গির টিকাকরণ পদ্ধতি এখনও চালু করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন ওই পরজীবী বিজ্ঞানী।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানিয়েছেন, তাঁদের আউটডোরে হামেশাই এই ধরনের জ্বর নিয়ে প্রচুর মানুষ আসছেন। তিনি বলেন, ‘‘সবটাই ভাইরাসঘটিত জ্বর। কিন্তু ভাইরাসের চরিত্রটা বদলে যাচ্ছে। এ বছর যে উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, পরের বছর হয়তো তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এই জন্যই আমেরিকায় প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক বদলানো হয়। বছরের শুরুতে কয়েক জন জ্বরাক্রান্তের সিরাম সংগ্রহ করে ভাইরাসের চরিত্রটা যাচাই করে নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে নতুন প্রতিষেধক তৈরি হয়ে বাজারে আসে। এখানে যে হেতু সে সব নেই, তাই ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক কোনও কাজেই আসছে না।’’