খাগড়াগড়-কাণ্ডে নাম জড়ানো সন্দেহভাজনদের পরিচয়পত্র সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠাল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। প্রশাসন সূত্রে খবর, নির্বাচন কমিশনের তরফে সেই চিঠি বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদএই চার জেলাশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটার পরিচয়পত্র তৈরি করতে গেলে যে সব নথি দরকার হয় (যেমন, জন্মের শংসাপত্র), ওই সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে সেগুলি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তা থেকে তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য মিলবে বলে গোয়েন্দাদের আশা। এনআইএ-র এক অফিসার জানান, এই ধরনের চিঠি পাঠানো তাঁদের রুটিন তদন্তের মধ্যেই পড়ে।
মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্ত বলেন, “চার-পাঁচজনের এপিক কার্ডের নম্বর দিয়ে, সেগুলি সম্পর্কে বিশদ তথ্য (ইলেকটোরাল ডিটেল) জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে এনআইএ। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির অ্যাসিস্টেন্ট রিটার্নিং অফিসারদের এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি এই সপ্তাহের মধ্যেই এনআইএ-র হাতে নথিপত্র তুলে দিতে পারব।”
বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী ও মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও জানান, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এমন কোনও চিঠি তাঁরা পাননি। অপর এক জেলা শাসক অবশ্য একান্তে স্বীকার করেছেন, ওই চিঠি তাঁর হাতে এসেছে।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, খাগড়াগড়ে নিহত শাকিল আহমেদ ভুয়ো নথি দিয়ে ভোটার কার্ড তৈরি করেছিল নদিয়ার করিমপুরে বারবাকপুরে। শ্বশুর আজিজুল গাজিকে বাবা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সেই ভোটার কার্ড তৈরি করেছিল সে। আজিজুল গাজির দাবি, “জামাই বলেছিল, ভোটার কার্ড হারিয়ে গিয়েছে। বারবাকপুরে থেকেই ব্যবসা করবে। মেয়ে-জামাইয়ের কথা ভেবে নতুন ভোটার কার্ডে আমার নাম ব্যবহারে সম্মতি দিই। সেটা ভুল হয়েছে।” কিন্তু আজিজুল রাজি হলেও, প্রশাসনিক কর্তারা কেন ভুয়ো নথিপত্র ধরতে পারল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রাজ্য পুলিশ বিস্ফোরণস্থল থেকেও বেশ কিছু পরিচয়পত্র পেয়েছিল। সেগুলি তৈরি করতে সুবহান, কওসরেরা শাকিলের মতো কোনও ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, তা জানতেও এনআইএ নথি জোগাড় করতে চাইছে বলে মনে করছেন অনেকে।
ভোটার কার্ড জালিয়াতি হওয়ার অর্থ, তা পাওয়ার জন্য যে সব নথি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও জাল করা হয়েছে। যেমন, বয়সের প্রমাণপত্র, রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জমির দলিল, প্রভৃতি। এনআইএ মনে করছে, ওই চারটি জেলায় শুধু ভোটার কার্ড নয়, যে কোনও ধরনের পরিচয়পত্রই জাল করার চক্র কাজ করছে। শুধু তাই নয়, পরিচয়পত্রের বাইরেও সচিত্র ভোটার কার্ড দেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের বুথ- লেভেল অফিসারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই করার কথা। তাতে যে গলদ রয়েছে, তা-ও বুঝিয়ে দিচ্ছে এনআইএ-র চিঠি।
ভোটার তালিকায় নাম নথিভূক্তির মতোই, নাম বাদ দেওয়াও জরুরি। যে কোনও নাগরিক কমিশনে অভিযোগ করলে ভোটার তালিকায় নাম তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। যে চার-পাঁচজন সম্পর্কে এনআইএ বিশদে জানতে চেয়েছে, তাদের কার্ড করার সময়ে কোনও অভিযোগও যে জমা পড়েনি, সেটাও চিন্তার বিষয়।
এ রাজ্যের পাশাপাশি অসমের কয়েকটি মাদ্রাসার সঙ্গে জেহাদ-যোগের কথা উঠে এসেছিল তদন্তে। মঙ্গলবার অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেন, “জেএমবি রাজ্যের বহু যুবককে নিয়োগ করার চেষ্টায় ছিল। অনেককে তারা দলে টেনেও নিয়েছে। পাশাপাশি, বাছাই মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি মহিলা শাখাও খোলার চেষ্টা করছে তারা। বরপেটা জেলা জেহাদিদের প্রধান ঘাঁটি হয়ে উঠেছে।” তবে রাজ্যর সব মাদ্রাসার উপরে নজরদারির সম্ভাবনা উড়িয়ে তিনি বলেন, “কয়েকটি মাদ্রাসার সঙ্গে জেহাদিদের যোগাযোগের কথা উঠে আসায় সব মাদ্রাসাকে সন্দেহের চোখে দেখা ঠিক হবে না।”
রাজ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে জেহাদি কার্যকলাপ রয়েছে দাবি করে গগৈ বলেন, “আমি ক্ষমতায় আসার পরে অন্তত ৮টি এমন সংগঠনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছি। আলফা বা এনএসসিএন-এর মতো উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে জেহাদি জঙ্গি সংগঠনগুলির ভাল যোগাযোগ ছিল। তবে এখনকার জেহাদি সংগঠনগুলির যোগাযোগ অনেক বেশি আন্তর্জাতিক।”
এনআইএ-র তদন্তকারীরা এ দিন বরপেটার একাধিক ব্যাঙ্কে শাহনুরের অ্যাকাউন্টগুলি পরীক্ষা করেন। তল্লাশি চলে শাহনুরের শ্বশুরবাড়িতেও। জানা গিয়েছে, শাহনুরের বাড়ি থেকে বেশ কিছু বাংলা সিডি মিলেছে। তাতে বিভিন্ন ভিডিও দেখিয়ে জেহাদের প্রস্তুতির ডাক দেওয়া হয়েছে। এই সব সিডি বিভিন্ন চর এলাকায় পাঠানো হত বলে জেনেছে পুলিশ।