নজরদারি নেই, ভেজাল দুধে মিশছে সাবানও

রাজ্যে ভেজাল দুধের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে এমনই তথ্য পেয়েছে রাজ্য পুলিশের এনফোর্সমেন্ট শাখা (ইবি)। রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে দেওয়া ১৭ পাতার একটি রিপোর্টে ইবি এই সব কথা বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ভেজাল দুধের কারবারে সরকারি নজরদারি ব্যবস্থার অভাব যে কতখানি, স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তা-ও।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:৩৪
Share:

কখনও ছানার জলে মেয়াদ উত্তীর্ণ গুঁড়ো দুধ আর অ্যারারুট গোলা হচ্ছে। কখনও কৃত্রিম ফেনা আনতে ভেজাল দুধে মেশানো হচ্ছে কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান। স্নেহ পদার্থের অভাব ঢাকতে মিশছে বনস্পতিও।

Advertisement

রাজ্যে ভেজাল দুধের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে এমনই তথ্য পেয়েছে রাজ্য পুলিশের এনফোর্সমেন্ট শাখা (ইবি)। রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে দেওয়া ১৭ পাতার একটি রিপোর্টে ইবি এই সব কথা বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ভেজাল দুধের কারবারে সরকারি নজরদারি ব্যবস্থার অভাব যে কতখানি, স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তা-ও।

বিক্রয়যোগ্য দুধের মান ঠিক আছে কি না, সেটা দেখার কথা ফুড সেফটি অফিসারদের। যারা স্বাস্থ্য দফতরের অধীন। কিন্তু খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিক পদে এখনও যে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিয়োগই করে উঠতে পারেনি, সেটা দফতরের কর্তারাই স্বীকার করে নিচ্ছেন। ফলে নজরদারির ফাঁক গলে বাজারে চলে আসছে ভেজাল দুধও। রাজ্য জুড়ে যে খোলা দুধ বিক্রি হয়, তার একাংশেও ফর্মালিন, মেলামিন, ইউরিয়ার মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে বলে ইবি-র দাবি।

Advertisement

কোন দুধ ভেজাল আর কোন দুধ নিরাপদ, সেটা মানুষ বুঝবেন কী করে? বাজারে যে সব সংস্থার দুধ পলিপ্যাক বা টেট্রাপ্যাকে পাওয়া যায়, তার মধ্যে হুগলির ডানকুনির সরকারি ডেয়ারি দিনে ছ’লক্ষ লিটার দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার তৈরি করে। বারাসতের আধা সরকারি ডেয়ারিটি সেখানে তৈরি করে দিনে চার লক্ষ লিটার। গুজরাতের দুগ্ধ সমবায়ের দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করে বাঁকুড়ার জয়রামবাটির একটি বেসরকারি ডেয়ারি। সেখানে দিনে পৌনে দু’লক্ষ লিটারেরও বেশি দুধ উৎপন্ন হয়। নদিয়ার মোহনপুরের সরকারি ডেয়ারিতে উৎপন্ন হয় দিনে ৫০ হাজার লিটারের কিছু কম দুধ। ইবি-র বক্তব্য, এই চারটি ব্র্যান্ডের দুধে এখনও গণ্ডগোল ধরা পড়েনি।

কিন্তু বিপদের কথা হল, দুধ সংগ্রহের সময়ে ডানকুনি বা বারাসতের ডেয়ারি যে দুধ ভেজাল বলে বাতিল করছে, সেই দুধই আবার অন্য পথে প্যাকেটবন্দি হয়ে চলে আসছে বাজারে। ইবি সূত্রে খবর, রোজ গড়ে ৫০-৬০ হাজার লিটার দুধ ভেজাল বলে বাতিল করা হচ্ছে।
কিন্তু তা চলে যাচ্ছে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার প্ল্যান্টে। প্রাথমিক ভাবে ইবি জেনেছে, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর, হুগলির জাঙ্গিপাড়া ও উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটায় ওই সব সংস্থার প্ল্যান্ট আছে। তিনটি জায়গা মিলিয়ে রোজ প্রায় ৬০ হাজার লিটার দুধ তৈরি হচ্ছে।

গত ২৬ জুন বারাসতের আধা সরকারি ডেয়ারিটি নদিয়া থেকে আসা ১৬০০ কেজি দুধ বাতিল করেছিল। কিন্তু মিনি ট্রাক ভর্তি ওই দুধ নষ্ট হয়নি, ফিরে যাচ্ছিল নদিয়ায়। কালীগঞ্জ থানার পুলিশ সেই গাড়ি ভর্তি দুধ আটক করে। নদিয়া জেলায় ডেয়ারির সংখ্যা ১৬টি। ইবি-র দাবি, এর কোনও একটিতে কম দামে বিক্রি করার কথা ছিল ওই বাতিল দুধ।

কিন্তু একটি ডেয়ারির বাতিল করা দুধ আদৌ অন্য ডেয়ারিতে পৌঁছতে পারছে কী করে? ইবি-র রিপোর্ট বলছে, কোনও ডেয়ারি যখন কোনও দুধ বাতিল করছে, তখন দুধ ‌ফিরিয়ে দেওয়ার চিরকুটে তারা লিখছে— ‘নট অ্যাকসেপ্টেড ফর আওয়ার কাইন্ড অব ইউজ। আমাদের মানের বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়।’ ইবি-র বক্তব্য, অন্য কোনও ডেয়ারি সস্তায় ওই দুধ কেনার সময়ে ভাষার ফাঁককেই কাজে লাগাচ্ছে। ক্বচিৎ-কখনও ধরা পড়ে গেলে বলছে, তাদের বিচারে ওই দুধের মান ঠিকই আছে। ইবি-র রিপোর্টে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ‘নোট অব মিল্ক রিটার্ন’-এ পরিষ্কার করে ‘রিজেক্টেড’ শব্দটি লেখা উচিত।

বাতিল হওয়া দুধ সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে না কেন? বিপুল পরিমাণ দুধ নিয়মমাফিক নষ্ট করে ফেলতে যে যন্ত্র দরকার, তা এই রাজ্যে এখনও বসানো হয়নি বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘কোনও ডেয়ারির বিরুদ্ধে এখনও কেউ নির্দিষ্ট অভিযোগ করেননি। আমার দফতরকে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দিতে বলেছি। তবে এটা দেখার কথা স্বাস্থ্য দফতরের।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন