কান্নায় ভেঙে পড়েছে কিশোর চন্দের মেয়ে সৃজা। ছবি: সন্দীপ পাল
সকাল তখন প্রায় দশটা। জলপাইগুড়ির ব্যস্ত স্টেশন রোডে একটি তিন তলা বাড়ির উপরের তলা থেকে একটানা কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন আশপাশের বাসিন্দারা। ফ্ল্যাটটির মালিক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী কিশোর চন্দ (৪৬)। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার মুখে কিশোরবাবুর মুহুরি বিবেক দে সরকার দেখেন সিঁড়ি দিয়ে এক ব্যক্তি নীচে নামছেন। তাঁর গায়ে রক্ত লেগে। বিবেকবাবু জানতেন, এই ব্যক্তিই একটু আগে কিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। পুলিশের কাছে তিনি দাবি করেছেন, কোনও একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে ভেবে তিনি তখন দৌড়ে কিশোরবাবুর ফ্ল্যাটে যান। দরজা খুলতেই দেখেন কিশোরবাবু উপুড় হয়ে পড়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। তাঁর দেহের পাশেই একটি বড় ছুরিও পড়ে ছিল বলে বিবেকবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন।
কী কারণে কিশোরবাবু খুন হলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে পুলিশের সন্দেহ, খুনি কিশোরবাবুর পরিচিত। কিশোরবাবু জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি দু’ধরনের মামলা করতেন। বালুরঘাটের আদি বাসিন্দা এই আইনজীবী থাকতেন শিলিগুড়িতে শরৎ বসু রোডের ফ্ল্যাটে। সেখানেই স্ত্রী দোলাদেবী ও মেয়ে সৃজা থাকেন। দোলাদেবী বিক্রয় কর দফতরের আধিকারিক। সৃজা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। জলপাইগুড়ির ফ্ল্যাটে তাঁর চেম্বার ছিল। সেখানেই তাঁর পোষা কুকুর সুইটি থাকত। তার দেখভাল করত কিশোরবাবুর গাড়ি চালক তারামোহন রায়। কিশোরবাবু নিজে সাধারণত চেম্বারের পরে শিলিগুড়ি ফিরতেন। কিন্তু রবিবার রাতে পরিচিতের বিয়ে থাকায় তিনি রাতে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন।
পুলিশ জেনেছে, এ দিন সকাল ৯টা নাগাদই বিবেকবাবু ও তারামোহনবাবু স্টেশন রোডের ওই ফ্ল্যাটে চলে আসেন। তার কিছু পরেই শ্যামবর্ণ স্বাস্থ্যবান এক ব্যক্তি কিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁর গায়ে সাদা জ্যাকেট ছিল। তাঁর জন্য গাড়ি চালককে দিয়ে চা-ও আনান কিশোরবাবু। তারামোহনবাবুও বিবেকবাবু এর পরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেন। কিছু পরে জ্যাকেটে রক্ত লাগা অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে ঘর থেকে বের হতে দেখে বিবেকবাবু ঘরে ঢোকেন। কিশোরবাবুকে ওই অবস্থায় দেখে তিনি তখন ব্যালকনিতে গিয়ে চিৎকার শুরু করেন। সুইটিও তখন পরিত্রাহি চিৎকার করছে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো হয়ে যান, খবর যায় পুলিশেও।
পুলিশ জানিয়েছে, চেম্বারের টেবিলে দু’টি চায়ের কাপ ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল ভাঙা। কিশোরবাবুর বসার চেয়ারও ভাঙা ছিল। তাঁর হাতেও একাধিক কাটা দাগ মিলেছে। তাই পুলিশের ধারণা, আততায়ীর সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তিও হয়েছিল। সে সময়ে মুহুরি এবং গাড়িচালক ঠিক কোথায় ছিলেন, তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। দু’জনকেই থানায় জেরা করা হচ্ছে।
যে ব্যক্তি রক্তমাখা জ্যাকেট পরে কিশোরবাবুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েছিলেন, তাঁকে এ দিন জলপাইগুড়ির স্টেশন লাগোয়া এলাকাতেও দেখা যায়। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সেই ব্যক্তি জানান, তিনি জখম হয়েছেন। এলাকার লোকজন তাঁকে তখন হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেন। সেই ব্যক্তি অবশ্য বলেন, তিনি বাড়ি গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন। এরপরেই দ্রুত এলাকা ছেড়ে স্টেশন লাগোয়া একটি গলি দিয়ে চলে যান।
সম্পন্ন আইনজীবী কিশোরবাবু সম্প্রতি জলপাইগুড়ি লাগোয়া মানিকগঞ্জ এলাকায় একটি চা বাগানও কিনেছিলেন। বাগানটি ভাল চলছিল না বলে তিনি সহকর্মীদের জানান। বেশ কিছু জমি সংক্রান্ত মামলাও ছিল তাঁর হাতে। পুজোর আগে আদালত চত্বরেই একটি মামলা নিয়ে কিশোরবাবুর সঙ্গে কয়েকজনের বচসা হয় বলে পুলিশ জেনেছে।
জলপাইগুড়ির রেঞ্জের ডিআইজি সিএস লেপচা বলেন, তদন্তে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, কিশোরবাবুর মাথার বাঁ দিকে, গলায়, ডান গালে, বুকে কোপ মেরেছে আততায়ী। কিশোরবাবুর ডান হাতের মুঠি থেকে হালকা খয়েরি রঙের এক গোছা চুল উদ্ধার করেছে পুলিশ। দোলাদেবীর বক্তব্য, ‘‘আমার স্বামীর শত্রু ছিল না বলেই জানি। কে তাঁকে খুন করল, জানি না।’’
কিশোরবাবুর বাড়ির উল্টো দিকেই বিচারকদের আবাসন, অন্য দিকে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবন। এলাকা থেকে ছ’শো মিটারের মধ্যে কোতোয়ালি থানা। এর মধ্যে ব্যস্ত এলাকায় ফ্ল্যাটে ঢুকে এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী খুন হওয়ায় এলাকায় আতঙ্কের সঙ্গে ক্ষোভও দানা বেঁধেছে। ঘটনার পরে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি এমনকী কলকাতা থেকেই আইনজীবীরা ফোনে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জেলা পুলিশের পদস্থ আধিকারিকরা আসেন। পুলিশ কুকুর দিয়ে তল্লাশিও হয়। তদন্তের কারণে আপাতত ফ্ল্যাটটি ‘সিল’ করে দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে রাজ্য সরকারের নির্দেশে সিআইডি-ও তদন্ত শুরু করেছে। রাজ্য বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অসিতবরণ বসু জানান, কিশোরবাবুকে খুনের প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার রাজ্যের প্রতিটি বার অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি পালন করবে। রাজ্য সরকারের কাছে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে।