River

ফাঁস জালে মাছ, বুকে ভাসানের ভয়ও

দূরে তখন টিমটিম আলোয় মাছ তুলছেন মনমোহন।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

কোচবিহার শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯ ১৭:১৫
Share:

বাড়ছে জল: ক’দিন আগেও পারাপারে এই বাঁশের সাঁকো ছিল ভরসা। জল বাড়তেই নেমেছে নৌকা। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

টর্চের মৃদু আলোয় ফাঁস জাল বসিয়ে দেন হাবুল। তার পর বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে অপেক্ষা। ঘড়ির কাটা ৩টে’র ঘরে ঢুকতেই, ডিঙি নৌকা নিয়ে আবার চললেন মাঝ নদীতে। নেঙটি পরে জলে নেমে জাল থেকে মাছ তুলতে শুরু করলেন। দূরে তখন টিমটিম আলোয় মাছ তুলছেন মনমোহন। হাবুল হাঁক দিয়ে বলেন, ‘‘মনমোহন মাছ কেমন?’’ যেন পদ্মানদীর মাঝি সেই কুবেরের সুর শোনা যায় তোর্সায় মাছ ধরতে নামা হাবুলের গলায়। চিত্রপটও যেন অনেকটা একই রকম। তবে কিছু পার্থক্যও রয়েছে। হাবুলের বয়স প্রায় ষাট। এক সময়ের তরতাজা যুবকের শরীর এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। এখনও এই তোর্সা নদী সম্বল করে বেঁচে আছেন ওঁরা।

Advertisement

কোচবিহার শহর থেকে নদীর এই জায়গাটা প্রায় দশ কিলোমিটার। কালীঘাটের বাঁধের উপরে বসে রয়েছেন হাবুল দাস। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখই তাকিয়ে রয়েছে তোর্সার দিকে। পাড়ে বাঁধা ডিঙি নৌকা। তার উপরে জাল আর মাছ রাখার পাত্র। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। পুব দিকে প্রায় ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল আভা তাঁর শরীরে। হাবুল বলেন, “এই নদী দিয়েছে অনেক। নিয়েছেও অনেক কিছু। এ সব মিলিয়েই আমরা বেঁচে আছি।” খানিকটা থম ধরে বসে থাকার পরে আবার হাবুল বলেন, “একসময় নদীতে প্রচুর মাছ ছিল। বোরোলিও প্রচুর উঠত। বেচে যে পয়সা পেতাম, তাতে ভালই চলত। এখন মাছই উঠতে চায় না।”

আর কিছু দিন পরেই বর্ষা নামবে। তার আগেই দিন কয়েকের বৃষ্টিতে ফাঁসিরঘাটে বাঁশের সাঁকোর অনেকটা জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে। এই সাঁকো পথেই রোজ হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করতেন। নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে গুমটি ঘরে বসে থাকতেন দেবকুমার’রা। পারাপারের জন্য মোটরবাইক ও মানুষ মিলিয়ে আট টাকা দিতে হয় ওঁদের। এখন ভূটভুটি নৌকা নিয়ে যাত্রী পাড়াপাড় করান দেবকুমার’রা। তাঁরা জানান, প্রশাসন ওই ঘাটটি সাঁকো তৈরি ও নৌকা চালানোর জন্য একটি সমবায় সমিতিকে লিজ দিয়েছে। তাঁরা ওই সমিতির লোক। দেবকুমার বলেন, “এই ঘাটই আমাদের জীবিকা দিয়েছে। কখনও নৌকা, কখনও সাঁকো।”

Advertisement

আরও পড়ুন: যন্ত্রণা নিয়েই ফিরতে হল ছোট্ট আফসানােক

ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা তোর্সার পাড় ঘেঁষেই কোচবিহার শহর। সেখানে নদীর অনেকটাই বুকে চর নিয়ে পড়ে থাকে প্রায় সারা বছর। শুধু ভরা বর্ষায় তার ভয়ঙ্কর রূপ। তাতে বাঁধের পাশে থাকা কোচবিহার শহর বেঁচে যায় ঠিকই, কিন্তু ভেসে যায় বহু গ্রাম। ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানা যায়, বন্যায় তোর্সার পাড়ের বাসিন্দারা ঘরহারা হয়েছেন বহুবার। গরমের সময় রোগাভোগা নদীর শরীরের বিভিন্ন জায়গা যে চর জেগে ওঠে, তা দখল করে বসতি তৈরি হতে থাকে। বর্ষায় যখন নদী দু’কূল ছাপায়, তখন ভেসে যায় সেই বসত।

এমনই চরে বাড়ি লায়লা বিবি’র। তিনি বলেন, “নদী গতিপথ বদলায় বারবার। তাই ঘরহারা হতে হয় আমাদের।” লায়লারা ঘরহারা হলেও নদীর প্রতি ভালবাসা রয়েছে তাঁদের। নদীর চরেই কোথাও গড়ে উঠেছে কলার বাগান, কোথাও তরমুজ খেত। কোথাও বোরো ধানের জমি সেচ ছাড়াই হয়ে উঠেছে সুজলা-সুফলা।

পদ্মা নদীর মতো হোসেন আলির সেই ময়নাদ্বীপ হয়তো গড়ে উঠেনি তোর্সায়, তবে চর পড়ে যাওয়া এই নদীতে জেগে ওঠা ছোট ছোট এমন দ্বীপই এখন সহায় মানুষের। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন