একই ক্লাসে পড়ে শ্রেয়া আর আকৃতি। এত দিন ক্লাসঘরে বসে একসঙ্গে পড়া শুনত, খাতায় নোট নিত। করোনা কিন্তু ছবিটা বদলে দিয়েছে। লকডাউনে স্কুল বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন শিক্ষকেরা। শ্রেয়ার হাতে তার মায়ের মোবাইল। কিন্তু আকৃতি কী করবে? তার তো বাড়িতে কোনও মোবাইল নেই! দশম শ্রেণির শ্রেয়া দে এখন পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে আকৃতি অসুরকে।
একই ভাবে ইভান মিত্র পড়াচ্ছে রাজ মুন্ডাকে। অনিন্দিতা হেলা পড়াচ্ছে সুনীতা মুর্মুকে। জলপাইগুড়ির চা বলয়ে পড়াশোনার ছবিটাকে একেবারে বদলে দিয়েছে ওরা।
বুদ্ধিটা অবশ্যই এসেছিল ওদের শিক্ষকদের মাথায়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকলে চা বলয়ের পড়ুয়ারা পিছিয়ে পড়তে পারে বলে নাগরাকাটার দু’জন প্রধান শিক্ষক অন্যান্য প্রান্তের শিক্ষকদের কাছে অনলাইনে ভিডিয়ো করে অথবা কথা রেকর্ড করে পড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে চা বলয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন জলপাইগুড়ি থেকে মালদহের ত্রিশ জন শিক্ষক। তার পরেই শুরু হয়েছে এই ক্লাসঘর, যেখানে কে কোন স্কুলের ছাত্র বা কে কোন স্কুলের শিক্ষক, ভেদ মুছে গিয়েছে।
তৈরি হয়েছে অজস্র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। তাতে যোগ দিয়েছেন জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, সুনীতি বালা সদর গার্লস স্কুল থেকে মালদহের মিল্কি হাইস্কুলের মতো একাধিক স্কুলের শিক্ষকেরা। আর আছে চা বলয়ের জনা সত্তর ছাত্রছাত্রী। শিক্ষকরা গ্রুপে ভিডিয়ো, অডিয়ো এবং ছবি দিয়ে পড়াচ্ছেন, বাড়ির কাজ করতে দিচ্ছেন, পড়াও ধরছেন। এই তালিকায় আছেন জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের শিক্ষক অরুণকিশোর ঘোষ, সদর গার্লসের শিক্ষিকা মিতালি লাহা, দেবারতি বসু, ধাপগঞ্জ স্কুলের শিক্ষক গৌতম চক্রবর্তী, মালদহের মিল্কি হাইস্কুলের শিক্ষক পরিতোশ দত্ত-রা। সত্তর জন ছাত্রছাত্রী তাতে সরাসরি অংশ নিচ্ছে। এই ছাত্রছাত্রীদের উপরেই ভার পড়েছে, যাদের মোবাইল নেই, তাদের পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার। তারা হয় বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে, অথবা তাকে ডেকে নিচ্ছে শিক্ষকদের তৈরি করা তালিকা ধরে। নাগরাকাটা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পিনাকী সরকার বললেন, “এক পড়ুয়া আর এক পড়ুয়ার বাড়িতে গিয়ে পড়াচ্ছে, নয়তো পড়া বুঝে আসছে।” দশম শ্রেণির ছাত্রী তৃষিতা পড়াচ্ছে রিয়াকে। তৃষিতা বলে, “শুধু মোবাইল নেই বলে বন্ধুদের পড়াশোনা বন্ধ থাকবে, এটা তো হতে পারে না।”
মাধ্যমিক সামনে বলে আপাতত দশম শ্রেণি দিয়েই ‘ক্লাস’ শুরু হয়েছে। পিনাকীবাবুর কথায়, “শুল্কাপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অনিমেষ নাগ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন পড়াশোনা স্কুলের গণ্ডিতে আটকে নেই।’’