উত্তরের চিঠি

চিকিত্‌সায় প্রগতির হাত ধরে আমার দেশে এখন মানুষের গড় আয়ু সত্তর ছুঁই ছুঁই। আর তাই বয়সে প্রবীণ, কিন্তু ভাবনায় স্থবিরতা নেই এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিদিন। আর সেই সব মানুষের প্রভাতী পথচলা এবং কথা বলার আসরে মাঝেমধ্যেই অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিতে শানিত কিছু আলোচনা উঠে আসে, যা অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে সাহায্য করে। কানে ঢুকলেও, মাথায় দোলা দেয় না। এ রকম নাগরিক শব্দতেই যখন আমরা অভ্যস্ত, তখনও পথচলতি কানে আসা প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন মগজে কড়া নাড়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২৭
Share:

দু’জেলাতেই সীমাবদ্ধ উন্নত চিকিত্‌সা পরিষেবা

Advertisement


সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড়। নেই পরিকাঠামো। নিজস্ব চিত্র।

চিকিত্‌সায় প্রগতির হাত ধরে আমার দেশে এখন মানুষের গড় আয়ু সত্তর ছুঁই ছুঁই। আর তাই বয়সে প্রবীণ, কিন্তু ভাবনায় স্থবিরতা নেই এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিদিন। আর সেই সব মানুষের প্রভাতী পথচলা এবং কথা বলার আসরে মাঝেমধ্যেই অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিতে শানিত কিছু আলোচনা উঠে আসে, যা অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে সাহায্য করে। কানে ঢুকলেও, মাথায় দোলা দেয় না। এ রকম নাগরিক শব্দতেই যখন আমরা অভ্যস্ত, তখনও পথচলতি কানে আসা প্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্ন মগজে কড়া নাড়ে।

Advertisement

উত্তরবঙ্গের প্রত্যেক জেলাতেই বেশ কিছু অর্থবান মানুষ আছেন, যাঁরা ব্যক্তি নিয়ে ভাবেন, ভাবেন সমাজের উন্নয়নকল্পে কী ভাবে আরও বাঙ্ময় হওয়া যায় মানুষের কাছে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাঙালিকে প্রতিনিয়ত সচেতনতার পাঠ দিয়ে যেতে হয়। তাই উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং মালদহ ছাড়া আর কোথাও বেসরকারি চিকিত্‌সা ব্যবস্থা সে ভাবে প্রসারিত হয়নি। কিন্তু বাকি জেলার ধনী ব্যক্তিরা একশো বছরের পুরনো বাড়ি কিনে দশতলা ফ্ল্যাট তুলেছেন। জলা বুজিয়ে জনগণের স্বার্থে তৈরি করছেন শপিং মল। অনেকে তৈরি করছেন থ্রিস্টার হোটেল। এগুলো আজকের যুগে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যে ‘মাচ নিডেড’। কিন্তু সেই সব ব্যক্তিদের মধ্যে কাউকেই স্বাস্থ্যপরিষেবা সংক্রান্ত ব্যবসায় উত্‌সাহী করানো যায়নি। অগত্যা সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড়। আউটডোরেও অসহায় গরিব রোগীর হতশ্রী অবস্থা। কিন্তু আজ আমরা কথায় কথায় তামিলনাড়ু, চেন্নাই, বেঙ্গালুরুর নাম করি। গুরুতর ব্যাধি মানেই দক্ষিণ ভারত। কিন্তু এই নির্ভরতা একদিনে তৈরি হয়নি। সেখানে আজ রিকশাওয়ালা থেকে অধ্যাপক-সবারই চিকিত্‌সা হয়।

কেন সর্ব ভারতীয় চিকিত্‌সায় এক নম্বরে থাকা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের থেকে বাংলার মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? কারণ, অবশ্যই দালালরাজ। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এখন দালাল ছাড়া আপনার কাছের মানুষকে চটজলদি ভর্তি করাতে পারবেন না। কানে শোনা নয়, চোখে দেখা। দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত্‌ মন্ত্রী-আমলাদের চিঠি নিয়ে দৌড়তে দেখেছি বন্ধুকে। সঙ্গে হৃদরোগী বাবা। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে চিকিত্‌সকেরা নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে ক’জন মিলেই খুলে দিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতাল। ফলে সেখানে পরিষেবা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্‌সার ব্যয়ভারও অনেকটাই কমেছে। উন্নত থেকে উন্নত পরিষেবার জন্য প্রতিযোগিতা রয়েছে সেখানে। কিন্তু বাংলায় এখনও বেসরকারি চিকিত্‌সা মানেই বেশি খরচ। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এখানে এখনও চিকিত্‌সাটা ব্যবসায় পরিণত হতে পারেনি। পারলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আরও স্বল্পমূল্যে চিকিত্‌সা সম্ভব হত। সঙ্গে থাকত ডাক্তারদের নিজেদের প্রমাণ করার একটা চ্যালেঞ্জ, যা এখন দক্ষিণ ভারতে রয়েছে। অনেকে বলবেন, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে এমন অনেক অস্ত্রোপচার হচ্ছে যা সর্বভারতীয় স্তরে বিরল।

কিন্তু ব্যতিক্রম রয়েছে বলেই তো এই লাভ ও লোভের বাজারেও সচ্ছল মানুষ হাসপাতালে ভরসা রাখে। কিন্তু তার স্থায়িত্ব নির্ভর করে পরিষেবার উপর। তাই উত্তরবঙ্গ যত দিন না পর্যন্ত চিকিত্‌সার জন্য শিলিগুড়ি আর মালদহের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসছে, তত দিন এ সব জায়গায় এক শ্রেণির মানুষ অসহায় মানুষকে বিপথে চালনা করবেই। অন্যান্য জেলাগুলিতেও যদি বেসরকারি চিকিত্‌সা-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন, তবে তুলনামূলক ভাবে নিম্নবিত্তরাও হাসপাতালে উন্নত পরিষেবা পাবেন। আর বিত্তবানরাও মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে দূরদূরান্তে যাবেন না।

এ দেশের চিকিত্‌সা ব্যবস্থাও এই মুহূর্তে অনেকাংশেই ব্যক্তিগত আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভরশীল। তথ্য বলছে, চিকিত্‌সা খরচের ৭০ শতাংশ গাঁটের কড়ি, বাকিটা সরকারের বদান্যতায় চুঁইয়ে পড়া। তাই সরকারও প্রেরণা হারিয়েছেন চিকিত্‌সা ব্যবস্থার পরিচালনায়। বেসরকারি ব্যবস্থার উন্নত পরিচালন পদ্ধতি ও দৃশ্যত প্রতীয়মান সাফল্যের খতিয়ান সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও ক্রমাগত এই ধারণার ভিত্তি দৃঢ় করেছে যে, সরকারি কর্মীদের পিছনে সময় ও অর্থব্যয়ের থেকে সরকারি চিকিত্‌সাক্ষেত্রেও বেসরকারি উদ্যোগীরা এলে আর্থিক সাশ্রয় হবে, সামাজিক সুফলও পাওয়া যাবে।

সন্দীপন নন্দী। বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন