হরিরামপুর কলেজ চত্বরে বোমাবাজি।
ছাত্র সংসদের ভোটকে কেন্দ্র করে এ বার বোমাবাজি, গুলি চালিয়ে হামলার অভিযোগ উঠল উত্তরবঙ্গে। ভাঙচুর হল পুলিশের জিপও। গত সপ্তাহেই ছাত্র সংসদের ভোটকে কেন্দ্র করে জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি কলেজ চত্বর রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। গত মঙ্গলবার শিলিগুড়ির মহিলা কলেজ সহ তিনটি কলেজে মনোনয়নপত্র তোলাকে ঘিরে মারধর-ইট ছোড়ার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। জখম হয়েছিলেন অন্তত ৫ জন। বুধবার সে সব ছাপিয়ে গেল দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর কলেজে। এবিভিপি সমর্থকরা মনোনয়ন পত্র জমা দিতে এলে তাঁদের উপরে গুলি, বোমা নিয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি)-র বিরুদ্ধে। সেখানে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থকরা পুলিশের জিপেও ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। পাল্টা অভিযোগ তুলেছে টিএমসিপিও। গোলমাল হয়েছে জেলার গঙ্গারামপুর কলেজেও। প্রতিবাদে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় ১২ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে এবিভিপি এবং বিজেপি।
উত্তরবঙ্গের ৪ জেলায় বুধবার কলেজ ভোটের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ছিল। আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং জেলার কলেজগুলিতে এ দিন মনোনয়ন পত্র তোলা এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার দিন ছিল। সব মিলিয়ে এ দিন বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন জখম হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সন্ধ্যে পর্যন্ত গ্রেফতার এবং আটকের সংখ্যা ছিল ৪। তাঁরা সকলেই বিরোধী দলের সমর্থক বলে দাবি।
বুধবার দুপুর ১টা নাগাদ দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর আব্দুল গণি দেওয়ান কলেজে গোলমাল শুরু হলেও, পুলিশ বাহিনী ঘণ্টাখানেক পরে পৌঁছয় বলে অভিযোগ। এ দিন সকাল থেকেই হরিরামপুর কলেজে চত্বরে টিএমসিপি সমর্থকরা জড়ো হয়েছিল বলে অভিযোগ। সে সময়ে কলেজের দূরে একটি জিপে জনাকয়েক পুলিশকর্মী থাকলেও, কলেজের গেটের সামনে কোনও পুলিশ বাহিনী ছিল না বলে জানা গিয়েছে। এবিভিপির ১৮ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে কলেজের সামনে পৌঁছতেই বাঁশ, লোহার রড নিয়ে টিএমসিপি কর্মীরা তেড়ে আসে বলে অভিযোগ। এবিভিপি-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা জেলা আহ্বায়ক অভিনন্দন দাসের অভিযোগ, টিএমসিপি লাঠি ও বাটাম নিয়ে হামলা চালায়। লাঠির আঘতে ৫ জন সমর্থকের মাথা ফেটে যায় বলে তাঁর দাবি। বাঁশ নিয়ে হামলা চলতে থাকার মধ্যে পরপর তিনটি বোমা ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পরপর দু’বার গুলি চলার শব্দও শোনা যায়। যদিও, বোমা এবং গুলিতে কেউ আহত হননি। টিএমসিপি অবশ্য বোমা-গুলি ছোড়ার কথা অস্বীকার করে গুলি চালানোর পাল্টা অভিযোগ তুলেছে এবিভিপি-র বিরুদ্ধে। দুই ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের সংঘর্ষে ৭ জন জখম হয়েছেন। তাদের মধ্যে এবিভিপির সমর্থক ৫ ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। টিএমসিপির দাবি, তাদের দুই সমর্থককে প্রাথমিক চিকিত্সা করাতে হয়েছে।
পুলিশের গাড়ি।
এদিন গঙ্গারামপুর কলেজেও টিএমসিপির হুমকির জেরে এবিভিপি মনোনয়ন দাখিল করতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “হরিরামপুর কলেজে মনোনয়ন পত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে দু’দল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৭ জন জখম হন। ৩ জনের আঘাত বেশি। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ঠিক নয়।”
বিজেপির জেলা সভাপতি গৌতম চক্রবর্তীর অভিযোগ, “টিএমসিপি হামলা চালালেও পুলিশ প্রশাসন দর্শক। এবিভিপি-র ডাকা দক্ষিণ দিনাজপুর জুড়ে ১২ ঘন্টা সাধারণ ধর্মঘটকে আমরা সমর্থন করেছি।” বন্ধের বিরোধিতা হবে বলে এ দিনই জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
হরিরামপুর কলেজ ভোটকে কেন্দ্র করে গোলমালের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। বাম আমল থেকেই তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত নেতা শুভাশিস ওরফে সোনা পালের নেতৃত্বে ছাত্র সংসদ ধরে রাখতে সক্ষম হয় টিএমসিপি। এ দিনও কলেজে গোলমালের ঘটনায় সোনা পালের নাম জড়িয়ে দিয়েছে তাঁর প্রাক্তন দল তৃণমূল-ই। তবে সোনা পাল দাবি করেন, “এখন কলকাতায় রয়েছি। হরিরামপুরে কোনও গোলমাল হলেই আমার নাম জড়িয়ে দেওয়া হতো। এখন তো আমি তৃণমূলে নেই। সবাই তো তৃণমূলের জেলা সভাপতির অনুগামী। পুলিশ তদন্ত করে দেখুক কারা গোলমাল করল।” দলের জেলা সভাপতি তথা আইন পরিষদীয় সচিব বিপ্লব মিত্র বলেন, “সোনা পালের মদতেই এবিভিপি সক্রিয় হয়ে গোলমাল পাকিয়েছে। এবিভিপির বহিরাগতদের বাধা দিলে মারমুখী হয়ে ওঠে। আমাদের ছাত্ররা কখনও পুলিশের গাড়ি ভাঙচূর করবে না। সব মিথ্যা কথা।”
হরিরামপুরে জখম এবিভিপি সমর্থক। ছবি: অমিত মোহান্ত।
গোলমাল হয়েছে উত্তর দিনাজপুরের দু’টি কলেজেও। বুধবার দুপুরে ইসলামপুর কলেজে ও ডালখোলার শ্রীঅগ্রসেন কলেজে ঘটনা দুটি ঘটেছে। দু’টি কলেজেই এ দিন-ই ছিল মনোনয়ন পত্র তোলার প্রথম দিন। ইসলামপুর কলেজে এবিভিপি সমর্থকদের পুলিশের সামনেই লাঠি ও বাঁশ দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। বাধা পেয়ে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর ট্রাক এবং একাধিক বাসে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে এবিভিপির বিরুদ্ধেও। বাসগুলি অবশ্য শোরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে জানা গিয়েছে। ছবি তুলতে গিয়ে এবিভিপি-র সদস্যদের হাতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপরে পুলিশ এবিভিপি-র ১ সমর্থককে আটক করে। ইসলামপুর থানার সামনে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক প্রায় দেড় ঘন্টা অবরোধ করে রাখে এবিভিপি-র সমর্থকরা। যদিও হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে টিএমসিপি। ছাত্র পরিষদের সদস্যদের থেকেও মনোনয়ন পত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ছাত্র পরিষদের তরফে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
গোলমাল হয়েছে ডালখোলা শ্রীঅগ্রসেন কলেজেও। এসএফআই-এর অভিযোগ, দুপুরে মনোনয়ন তুলতে যাওয়ার সময় টিএমসিপি কর্মীরা হামলা চালায়। হামলায় এক এসএফআই সমর্থকের মাথা ফেটে যায় বলে দাবি করা হয়েছে। ডালখোলা এলাকাতে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক প্রায় ১ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে এসএফআই।
মঙ্গলবারের মতো বুধবারেও শিলিগুড়ি থেকে দক্ষিণ দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ার থেকে ইসলামপুর বেশিরভাগ কলেজের গেট টিএমসিপি-র ‘দখলে’ ছিল বলে অভিযোগ। ফালাকাটা কলেজ মনোনয়ন পত্র জমা দিয়ে যাওয়ার সময়েই এসএফআইয়ের মিছিলে টিএমসিপি-র হামলার অভিযোগ উঠেছে। এসএফআইয়ের দাবি, হামলায় ৩ জন সমর্থক জখম হয়েছে। অন্য দিকে, বিরোধীরা মনোনয়ন তুলতে না পারায় আলিপুরদুয়ারের ৪টি কলেজে টিএমসিপি ছাত্র সংসদ দখল করতে চলেছে বলে দাবি করেছে। জয়গাঁ ননী ভট্টাচার্য স্মারক কলেজে আরএসপি-র ছাত্র সংগঠনের সমর্থকরা মনোনয়ন তুলতে গেলে টিএমসিপি-র হুমকিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয় বলে অভিযোগ। কুমারগ্রামের কামাখ্যাগুড়ি শহিদ ক্ষুদিরাম কলেজে আরএসপির ছাত্র সংগঠনের ২ কর্মীকে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। অভিযোগ অস্বীকার করেছে টিএমসিপি। বিরোধীরা মনোনয়ন না তোলায় রায়গঞ্জ আইটিআই কলেজের ছাত্র সংসদও টিএমসিরপি-র দখলে যেতে চলেছে বলে সংগঠনের দাবি।
—নিজস্ব চিত্র।